দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা শুরুর আগে দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, প্রথম-তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নেওয়া, দশম শ্রেণির আগে কোন ধরনের পাবলিক পরীক্ষা না হওয়া, দশম শ্রেণির পর বিভাগ পরিবর্তন, বই ও বিষয় কমিয়ে আনা এর মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা ব্যবস্থায় আসন্ন পরিবর্তনের অধিকাংশই সাধুবাদ পাওয়ার মতো। তবে আরও বেশ কিছু পরিবর্তন  হওয়া উচিত আরও যুগপোযগী ও সূদুরপ্রসারী।

প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অন্তভুক্ত করার সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর করছে না সরকার। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অন্তভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন হলো বই কমানো ও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার চাপ কমানো। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষার সিস্টেম তৈরী রাখা হয়নি।

পরীক্ষা পদ্ধতিতে চালু হবে পরবর্তী ক্লাসে। তবে পরবর্তী ক্লাসগুলোতেও রোল নাম্বার পদ্ধতি না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমবে।

আসন্ন পরিবর্তনে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণিতে গিয়ে প্রথম পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিভাগ বহাল থাকবে। দশম শ্রেণিতে পরীক্ষার জন্য রাখা হয়েছে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান। এর ফলে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে দশম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা শেষ করা যাবে। তবে প্রস্তাব থাকবে এই পরীক্ষা যেন বছরের শেষে নভেম্বর, ডিসেম্বরে নেওয়া হয় এবং জানুয়ারীতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে নতুন বছরে গিয়ে পরীক্ষা নেওয়াতে শিক্ষার্থীদের একটি বছর গ্যাপ হয়ে যায়।

আরেকটি পরিবর্তনের কথা বলা যাচ্ছে একাদশ শ্রেণিতে বিভাগ পরিবর্তন ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে দুইটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আমার প্রস্তাব, উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে স্কুল পর্যায়ে অন্তভুক্ত করে ফেলা হউক। সম্ভব হলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিভাগই রাখা হউক। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে গণিত/ইংরেজি/বিজ্ঞান/ সমাজবিজ্ঞানে করা ফলাফল অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পড়িত বিষয় ঠিক করবে। যারা বিজ্ঞানে ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাদের জন্য উচ্চতর গণিতের মতো উচ্চতর বিজ্ঞান নামে অতিরিক্ত একটি বিষয় রাখা যেতে পারে।

বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সিলেবাসের মধ্যে বিস্তার পার্থক্য। নবম-দশম শ্রেণিতে যে সিলেবাস ২৭-২৮ মাসে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০-২২ মাসে তার চেয়ে চারগুণ সিলেবাস পড়তে হয় । ফলে অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ-দ্বাদশ) শ্রেণিতে গিয়ে পড়ার চাপ নিতে পারে না। এই চার বছরের সিলেবাসের ভারসাম্য করা আশু জরুরী।
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে স্কুল পর্যায়ে অন্তভুক্ত করার দাবির আরও বেশ কিছু কারণ আছে। আমাদের দেশে ভাল কলেজ মানেই শহররাঞ্চলের কলেজ। ফলে ভাল কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে শিক্ষার্থীদের পাড়ি দিতে হয় শহরে।  গ্রাম থেকে ভাল কলেজে পড়তে এসে মেসে থাকা ও নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার এক কষ্টসাধ্য সময় পার করতে হয় গ্রামের শিক্ষার্থীদের। ফলে বেশীরভাগ শিক্ষার্থীরা উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে ভাল ফলাফল করতে পারে না। উচ্চমাধ্যমিকের পর ঝরে পড়ার ঝরে পড়ার এটাও একটা কারণ।  এছাড়া উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের দেশে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবের সুযোগে দেশের শিক্ষা ব্যবসায়ীরা রমরমা কলেজ বানিজ্য করছে। একটি সাইনবোর্ড ও কয়েকটা রুম ভাড়া নিয়ে যে কেউ কলেজ খুলে বসছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতারিত হচ্ছে গ্রামের সহজ-সরল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তাই স্কুল থেকে একসাথে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করিয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়ার জন্য উপযুক্ত করা হউক শিক্ষার্থীদের। স্কুলের পর কলেজ বলতে যেন স্নাতক পর্যায়কেই বুঝানো হয়।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দেওয়ার কথা বলে আসতেছিল। প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ঘোষণাও ছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়া খুব একটা অগ্রসর হয়নি। বাংলাদেশকে কাঙ্খিত উন্নয়নের স্তরে পৌঁছাতে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। অষ্টম/দশম শ্রেণির পর বর্তমান শিক্ষার পদ্ধতির পাশাপাশি ২-৪ বছরের কারিগরি ডিপ্লোমা কোর্স পড়ার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হউক প্রতিটি উপজেলায়। অষ্টম/দশম শ্রেণি পাশ করার পর শিক্ষার্থীদের অন্তত ৩০% কে ধীরে ধীরে কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনা হউক। বাংলাদেশী অভিবাসীরা যে শ্রম দেয় তার তুলনায় অনেক কম রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে। তার কারণ কারিগরি জ্ঞানের অভাব। আমরা যদি কারিগরি শিক্ষায় একটা পরিবর্তন আনতে পারি তবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সম্পদ হয়ে উঠবে। বৈদেশিক রেমিট্যান্সের বাজারে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সম্ভাবনাময়ী শক্তি।

দ্বাদশ শ্রেণি বা সমমান পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়ার আগে সকল নাগরিক বাধ্যতামূলক ছয়মাসের ট্রেনিংয়ে নেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হউক। এই ট্রেনিংয়ে প্রতিটি নাগরিককে দেশপ্রেম, দেশের সংবিধান ও দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ট্রাফিক আইন, মানবিকতা , সমাজকর্ম, লিঙ্গীয় সমতা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হউক। এছাড়া সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণের কথাও ভাবতে পারে সরকার।

বর্তমানে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় যেরকম সরকারী সার্টিফিকেট পাচ্ছে সেখানে সমাজসেবামূলক সেচ্ছ্বাসেবী কাজকেও মূল্যায়ন করা উচিত। অনেক কিশোর বয়স্ক শিক্ষা, জলবায়ু নিয়ে সচেতনা, ধর্ষণ বিরোধী সচেতনা, নাটক, গান ইত্যাদি কাজে যুক্ত হয়। কিন্তু তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ারে শুধুমাত্র পাঁচটি বইয়ের পড়ার সার্টিফিকেট যুক্ত থাকবে তা হয়না।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা জন্য দ্ইু বছর যে নির্ধারণ করা হয়েছে তা অনেকাংশে শিক্ষার্থীদের জন্য চাপ হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীদের একটা বয়স পর্যন্ত বাবা মায়ের কাছেই থাকতে দেওয়া উচিত। সরকার সপ্তাহিক ছুটি দুই দিন নির্ধারণ করেছে। তবে সপ্তাহের একটা দিন পড়ালেখার বাইরে শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য রাখা উচিত। সরকার যেভাবে প্রতিটি ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড ও কম্পিউটার সংযোগ দিয়েছে সেভাবে সংযোগ দেওয়া হউক প্রতিটি প্রাইমারী স্কুলে। সপ্তাহে একদিন শিক্ষার্থীদের মুভি দেখানো হউক, শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখানো হউক। অথবা শিশুরাই করুক নিজেদের পারফরম্যান্স। এরফলে স্কুল হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীদের আনন্দের ঠিকানা। স্যার, ম্যাডাম শব্দ আমাদের দেশে বেশ ভীতিকর শব্দ। ফলে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকদের স্যার , ম্যাডামের পরিবর্তে অন্য কোন নামে ডাকার প্রচলন করা যেতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলে লাইব্রেরী জনপ্রিয় করা হউক। আমাদের ছেলেরা রবীন্দ্র নজরুল পড়ে না বলেই কম বয়সে হাতাশায় নিমজ্জ্বিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাল করা শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ চালু করা হউক। অন্তত ৫০% শিক্ষার্থীকে মেধা ও আর্থিক সক্ষমতা উপর ভিত্তি করে দেওয়া হউক বৃত্তি। সরকার পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য সরকার এত টাকা খরচ করছে, কিন্তু পকেটমানি জোগাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের টিউশনি আর জ্যামের রাস্তায় পার করতে হয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। যদি মাসে পাঁচ হাজার টাকা স্কলারশিপ পেতো তবে এই ছেলেদের প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘন্টা সময় সাশ্রয় হতো। যে সময়টা সে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারত। আশা করি বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইতে বাংলাদেশ ইতিবাচক পরিবর্তনের পথেই হাঁটবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031