একজন অভিভাবককে প্রশ্নটা করলে প্রথমে একটু অবাক হবেন হয়তো। আপনার স্কুলপড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটি পড়াশোনার বাইরে কি নিয়ে ব্যস্ত থাকে অবসর পেলে? কিছুটা সময় পরে বলবেন-ও মোবাইল নিয়ে গেমস খেলে। পড়াশোনার ব্যাপারে মোবাইল কাজে লাগে, তাই ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরে কোথাও ঘোরার পরিবেশ নেই। তাই ঘরে বসে সময় পার করে, পড়াশোনা শেষ করে।

খুবই যুক্তিসংগত কথা। শহরে একটুও ঘোরার পরিবেশ নেই। খেলার মাঠ নেই। বিনোদন কেন্দ্রগুলো মাদকাসক্তদের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। স্কুলপড়ুয়া কিশোর বা কিশোরী কোথায় যাবে? ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে একটা কিছু নিয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই মোবাইল নিয়েই থাকে।

আমাদের একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এই ‘মোবাইল ডিজিজ’ নিয়ে। বলা যেতে পারে ‘মোবাইল ডিজেবল’ হয়ে বেড়ে উঠছে। এভাবে বললে একটু বেশিই বলা হয়ে যায়। সত্য কথা কঠিন মনে হয়, ‘তবুও কঠিনেরে ভালোবাসতে’ হবে।

বাসায় কোনো আত্মীয়স্বজন এলে দেখতে পান আপনার ছেলেটি বা মেয়েটি পড়ার টেবিলে বা বিছানার এক কোনায় বসে একমনে মোবাইল নিয়ে মেতে আছে। মাথা নিচু করে কুঁজা হয়ে দুই হাতের বুড়ো আঙুল মোবাইলের ওপর রেখে একটা কিছু করছে। বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করছে, নয়তো ফেসবুক বা কোনো গেমস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। এর বাইরেও ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে নানা সাইটে ঢুকে দেখার চেষ্টা করে। সেই সাইটে ঢুকে অনেক কিছুর সঙ্গে নির্দিষ্ট বয়সের আগেই মানবজীবনের অনেক চিরায়ত বিষয় জেনে যাচ্ছে। যার কোনোটা তার নৈতিক চরিত্রের স্খলন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে কখনো কখনো।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এভাবে বসে বসে কুঁজা হয়ে একমনে মোবাইলে নিমগ্ন থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব হয়তো এখন বোঝা যাবে না। কিছুদিন পর দেখা যাবে তার ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত খানিকটা বাঁকা হয়ে গেছে। তার কথাবার্তা, আচার-আচরণেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এটাকে ‘মোবাইল ডিজেবল’-এর লক্ষণ বললে খুব বেশি বলা হবে?

এই যে ‘মোবাইল ডিজেবল’ হয়ে বেড়ে উঠছে আপনার প্রিয় সন্তানটি, এর পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এক সময়। প্রথমত পারিবারিকভাবে বিষয়টি দেখা যেতে পারে। আপনার নিকটাত্মীয়রা মুখ ফুটে হয়তো বলেই বসতে পারেন- ‘তোমাদের বাসায় গিয়ে কি করব? তোমার ছেলেমেয়ে ব্যস্ত থাকে মোবাইল নিয়ে। আদব-কায়দা তো কিছুই শিখেনি মনে হয়। ভালো-মন্দ কিছু জিজ্ঞাসাও করে না, এতদিন পরে গেলাম সেবার।’ এর ফলে আপনি নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন ধীরে ধীরে।

আপনার প্রতিবেশীরাও একসময় একই অভিযোগ করতে পারেন। সেটাও না হয় আপনি মেনে নেবেন যে, এটা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এর ধারাবাহিক সমস্যাটাই সবচেয়ে কঠিন হবে। যখন আপনার ছেলেটি বা মেয়েটি আপনার অবাধ্য হয়ে যাবে। আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না প্রিয় সন্তানটি।

তার মানে আমার সন্তানকে মোবাইল দিব না? এমন প্রশ্নও কোনো কোনো অভিভাবক করতে পারেন। অবশ্যই মৌলিক প্রশ্ন। প্রিয় সন্তানকে মোবাইল কিনে দিতে কার না মন চায়? তবে বয়স বিবেচনায় নিয়ে মোবাইল হাতে দেওয়াটাই সব দিক থেকে ভালো। পাশাপাশি এটাও বলে দেওয়া উচিত, আপনার ছেলে বা  মেয়েটি কখন মোবাইল ব্যবহার করবে। অপ্রয়োজনে মোবাইল নিয়ে বসে না থাকার বিষয়টিও বোঝাতে হবে ভালোবাসা দিয়ে।

আপনি যদি সচেতন অভিভাবক হয়ে থাকেন বা নিজেকে সচেতন অভিভাবক ভাবেন, আপনার প্রিয় সন্তানকে মোবাইল কিনে দেওয়ার আগে একটু ভেবে দেখতে পারেন। ‘মোবাইল ডিজেবল’ যেন না হয়ে ওঠে প্রিয় সন্তানটি। যার খেসারত দিতে হবে আপনাকে, সমাজকে।

আমার-আপনার সন্তান সুন্দর মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে, আনন্দে হাসবে, নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে মন খুলে কথা বলবে, সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে সে রকম পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব তো আমাদেরই। ‘মোবাইল ডিজেবল’ শব্দটা পরিচিত না হয়ে উঠুক, এমনটাই প্রত্যাশা সব অভিভাবকের।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031