এখন উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত বহু স্বপ্ন, প্রত্যাশা, আবেগের পদ্মা সেতু । চলতি মাসের ২৫ তারিখ এই সেতু উদ্বোধন হবে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও ক্ষণগণনা। অনেক টানাপড়েন, সমালোচনা, সন্দেহ, অবিশ্বাসকে পেছনে ফেলে, বিপুল ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে এই সেতু। বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওচিত্রে পদ্মা সেতুর যে ছবি দেখা যাচ্ছে, তাতে মন ভরে যাচ্ছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজেদের অর্থায়নে এমন একটি বৃহৎ ও অপূর্ব সুন্দর সেতু আমাদের দেশে নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে, এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়!
পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের কোটি কোটি মানুষের প্রধান অগ্রাধিকার, বহু যুগের লালিত স্বপ্ন, এ কথা যেমন ঠিক। পাশাপাশি এই সেতু কঠিন জেদ ও প্রতিজ্ঞার ফসলও বটে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাত দিয়ে যেন এই সেতু হতে না পারে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা যেন এই সেতুর অর্থায়ন না করে, সেটা নিয়ে ‘আওয়ামীবিরোধী’ এবং ‘বাংলাদেশবিরোধী’ একটি বিশেষ চক্রের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। তাদের তৎরতার ফল হিসেবে সেতুর কার্যক্রম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এটা ছিল ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য একটা চরম আঘাত। একই সঙ্গে সেতুর আকাক্সক্ষা লালনকারী কোটি কোটি মানুষের জন্যও তা ছিল বজ্রাঘাতের মতো। সেই বৈরী পরিস্থিতিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, পদ্মা সেতু হবে এবং সেটা হবে আমাদের নিজস্ব টাকায়।
প্রতিপক্ষ যেখানে বিশ্বব্যাংক, আরও স্পষ্ট করে বললে আমেরিকা, তার সঙ্গে লড়লেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ওবামা প্রশাসনের একাংশ, বিশ্বজোড়া প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন বাংলাদেশের কোনো কোনো বিশিষ্টজন, বিএনপি-জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধাী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কানেকশন। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিপক্ষরা অপ্রতিহত ক্ষমতাধর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ’ আমলাগোষ্ঠী এবং চাটুকার ও ‘খাই খাই স্বভাবের’ নেতাকর্মীদের নিয়ে মূলত একাই লড়লেন, তার দৃঢ় মনোবলের কাছে দুনিয়ার সবাই, আর কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল। শুধু একজন মানুষের জেদ, পদ্মার বুক চিরে নতুন সেতুর জন্ম দিল।
নিজেদের টাকায় হাজার হাজার কোটির এই বিশাল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার শুনে সেদিন অনেকেই হাসাহাসি করেছিল। অনেকের কাছেই তা ছিল কথার কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুকে নিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের তিনি বুঝিয়ে ছেড়েছেন, তিনিও ‘শেখের বেটি!’ কারও চোখ রাঙানিতে নত হওয়া বা নাকে খত দেওয়া তার ধাতে নেই। তিনি কারও কাছে মাথা বন্ধক রেখে চলেন না। পদ্মা সেতু শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় ষড়যন্তকারীদের মুখে ছাই ঢেলে দেওয়ার জেদ বাস্তবায়নের সেতু। সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং সফল হয়েছেন।
এ যেন এক রহস্য-উপন্যাসের কাহিনি। প্রথমেই তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করেন। এর পর নিজেদের টাকায় তিনি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো দক্ষিণাঞ্চলে শুরু হয় মহাকর্মযজ্ঞ। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। পদ্মা সেতু একটু একটু করে উদ্ভাসিত হয়। পদ্মা সেতু এমন একটা সেতু, যার প্রতিটি কর্মকাণ্ড, নির্মাণকাজের প্রতিদিনের অগ্রগতি নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রতিটি ইট-বালু-কংক্রিট-লোহা কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নকেই যেন বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
যা হোক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক মানুষের শ্রম-ঘাম-আত্মত্যাগের ফসল এই পদ্মা সেতু এখন যান চলাচলের জন্য প্রায় প্রস্তুত। তবে রাজধানীবাসীর জন্য পদ্মা সেতু বাড়তি যানজটের শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে সম্ভাব্য যানজট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যানবাহনের চাপ বাড়বে। এসব যানবাহনের ঢাকার ভেতর দিয়ে পদ্মা সেতুতে ওঠা ছাড়া কোনো বিকল্প এখন পর্যন্ত নেই। ফলে পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার যানজট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ একটি ভালো সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এখন পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে না ঢুকেও যানবাহনগুলো পদ্মা সেতুতে উঠতে পারবে- এমন বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়নি। ঢাকা ঘিরে বৃত্তাকার একটি সড়কপথ তৈরির কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সে ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ঢাকার দোলাইরপাড় থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে গেলেও ঢাকার অসহনীয় যানজট অতিক্রম করেই যেতে হবে। অন্যদিকে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে যেসব যানবাহন ঢাকায় ঢুকবে সে ক্ষেত্রেও যানজট বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব যানবাহন ঢাকায় ঢুকবে সেগুলো এক্সপ্রেসওয়ে পার হয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠবে। এসব যানবাহন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান ও চানখাঁরপুলে নামবে। এতে করে ফ্লাইওভারে ওঠা ও নামার পথে বাড়তি যানজট সৃষ্টি হতে পারে।
ঢাকা-উত্তরবঙ্গ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দক্ষিণবঙ্গমুখী যানবাহনের রাজধানী এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে যাওয়ার পথ নেই। এই সমস্যা সমাধানে আবদুল্লাহপুর-ধউর-বিরুলিয়া-গাবতলী-সোয়ারীঘাট-বাবুবাজার-কদমতলী-তেঘরিয়া-পোস্তগোলা-ফতুল্লা-চাষাঢ়া-হাজীগঞ্জ-ডেমরা হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ঢাকার চারদিকে ইনার সার্কুলার রুট নির্মাণের পরিকল্পনা করে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।
এই ইনার সার্কুলার রুট হলে দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে আসা গাড়ি ঢাকা শহরকে এড়িয়ে যেতে পারত। একই সুবিধা পেত পদ্মা সেতুমুখী গাড়ি। যানজট নিরসনে ২০০৪ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনায় (এসপিটি) সার্কুলার রুট নির্মাণের সুপারিশ ছিল। পরে ২০১৫ সালের সংশোধিত এসটিপিতে (আরএসটিপি) ঢাকাকে ঘিরে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণের কথা বলা হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। গাবতলী-কদমতলী বেড়িবাঁধের সড়ক প্রশস্ত করে এবং সোয়ারীঘাট থেকে কদমতলী পর্যন্ত উড়াল সড়ক করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে সার্কুলার রুটের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও নানা সময়ে শোনা গেছে। এ সড়ক হলে গাবতলীর গাড়ি শহরে প্রবেশ না করে পদ্মা সেতুতে যেতে পারবে। কিন্তু কবে হবে সার্কুলার রুটের কাজ- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ২১ জেলায় যাবে যানবাহন। তা ছাড়া সেতু কেন্দ্র করে চলাচলও বাড়বে। সেতুর কারণে জেলাগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকা-ও বিস্তৃত হবে। জেলায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এই সেতু দিয়েই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে। সাম্প্রতিক একটি সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিদিন ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার যানবাহন ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সংখ্যা প্রতিদিন আনুমানিক ২৫ হাজারে উন্নীত হবে। দশ বছরের মধ্যে তারা প্রতিদিন ৪৫ হাজারে দাঁড়াবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুততম হবে। ফলে এই যে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে সেই চাপ সামাল দিতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে যানজটে স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে রাজধানী ঢাকার।
যানজটের বিষয়টিও গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। যানজট রাজধানীবাসীর জন্য এক অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ২০২২ সালে ঢাকার সড়কে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। যানজটের কারণে প্রতিদিন যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। যানজটের আরেকটি ক্ষতি হলো রাস্তার আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি থেমে থাকলে রাস্তার আয়ুষ্কাল ১৮-৩০ শতাংশ কমে। শুধু তাই নয়, যানজটের কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে, রোগব্যাধি বাড়ে, মানসিক রোগ জটিল আকার ধারণ করে। কাজেই পদ্মা সেতু যেন রাজধানীবাসীর জন্য নতুন করে যানজট সৃষ্টি না করে, সে ব্যাপারে এখনই সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেসব প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখছে না, সেগুলোকে এক নম্বর অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। পদ্মা সেতু যেন দেশের সব মানুষের জন্য সমান আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক
