রাজপথে প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মচারীরা । তারা বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখা অর্থাৎ ‘সংবিধান’ ও ‘রাষ্ট্র’কে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা
সংবিধানের প্রতি তাদের ‘আনুগত্য’ ও ‘অভিপ্রায়’ ঘোষণা করেছে। এটাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কর্মচারীদের প্রকৃত ‘শাসনতান্ত্রিক, আইনগত ও নৈতিক কোড’।
সাংবিধানিক শাসন ছাড়া রাষ্ট্র যে দুর্বৃত্তপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লাভ করছে এবং এটা আমাদের জন্য যে ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তা অন্তরাত্মায় উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সাংবিধানিক শাসনের বাইরে যেকোনো শাসনব্যবস্থা নিষ্ঠুরতা এবং সহিংসতার জন্ম দেয়, সংঘাতকে উসকে দেয়, রক্তক্ষয়ী অবস্থার সৃষ্টি করে এবং অত্যাচার ও সহিংসতা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। এটা রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক।
সংবিধানকে উপেক্ষা করে জন্ম নেয়া অপশাসন রাষ্ট্রকে তার নৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করে, সংবিধানের লক্ষ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধার সৃষ্টি করে এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে। অপশাসনের ভীতি একটি রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের অপঘাত ও হুমকি। অপশাসনের বিপদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি পরিচালিত করতে হবে।
সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক, মানবিক ও নৈতিক বাংলাদেশের স্বপ্ন থেকে জনগণকে কেউ কোনো দিন বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
অপশাসনের সর্বগ্রাসী ছায়া, অপরাজনীতির বিস্তার এবং ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্থানের এই পর্বে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সাংবিধানিক প্রধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার শপথ আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে আলোকপাত করা জরুরি।
সংবিধানকে সমুন্নত রাখার সত্য উচ্চারণ আমাদের বিদ্যমান রাজনীতির জন্য এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য, মানবিক বোধ, অবিচ্ছিন্ন সততা, চিন্তার তীব্রতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেবে। নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিপরীতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ভিত্তিক গণমুখী রাষ্ট্র বিনির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম‘ অর্থ ‘অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার-সংক্রান্ত যেকোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হতে পারে, এইরূপ অন্য কোনো কর্ম; এবং ১৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এই সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে সংসদ আইন দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। আবার সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদি যুক্ত পদে অধিষ্ঠিত কর্মরত কোনো ব্যক্তি- উল্লেখ করা হয়েছে।
নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্যের প্রশ্নে সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য ?আর সংবিধানের ২১(২) বলা হয়েছে সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ ১৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। কিন্তু ১৩৫ অনুচ্ছেদ অসামরিক সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনতির প্রশ্নে শর্ত সংযুক্ত করেছে।
সুতরাং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ঘোষণা দিয়েছেন তারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পালন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাদের এই ঘোষণায় সর্বজনীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে। গণতন্ত্রায়নের চিন্তা-চেতনা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবেই লালন করতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ দৃশ্যমান সর্বসম্মত জনমতকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে যাচ্ছি। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আজকের ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিদ্যমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সহজপাঠ বইয়ের মুখবন্ধে বলেছেন ‘রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের রাজনৈতিক সংগঠন এবং সংবিধান এই সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব ছিল একমাত্র রাজার। কালে দাবি উঠলো জনগণের সার্বভৌমত্ব চাই। এলো সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি-মানুষ সরাসরি জায়গা পেলো না। সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ শাসকশ্রেণি তৈরি করলো যার শেষ ফলাফল দেখা গেল ফ্যাসিবাদ। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এই আপদ থেকে বাঁচার উপায় বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্নিহিত আছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি-মানুষের কি সম্বন্ধ থাকা উচিত? প্রশ্নটিই কঠিন হলেও বাংলাদেশের সংবিধানে তার একটা সহজ উত্তর পাচ্ছি। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের এমন রূপরেখা দেয়া আছে যেন প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকার থাকে, রাষ্ট্রপরিচালনা যেন গোটা সমাজের ব্যাপার হয়।
এছাড়াও বিচারপতি গোলাম রব্বানী বলেছেন, বাস্তবে সংবিধানে নির্দিষ্ট উপরিউক্ত আচরণবিধি পালিত হচ্ছে না। তার প্রধান কারণ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ইংরেজ আমলের উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বহাল আছে। এটা যে গণমুখী নয় তা ২০০ বছর আগে ১৭৯৩ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ব্যবস্থার সংস্কার করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলাদেশে উপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণে জনগণ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। স্বাধীনতা লাভ করেও জনগণ পরাধীনতার আবহে বসবাস করছে। উপনিবেশিক লড়াইয়ের দু’টি দিক, একটি হলো ‘বহিরাগত’, আরেকটি হলো ‘অভ্যন্তরীণ’। আমরা ৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘বহিরাগত’ উপনিবেশকে বিতাড়িত করেছি, কিন্তু উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা অক্ষত রাখায় ‘অভ্যন্তরীণ’ উপনিবেশকে বিতাড়িত করতে পারিনি।
বৃটিশ পাকিস্তানি শাসকগণ আমাদেরকে উপনিবেশ হিসেবে তাদের শাসন-শোষণের কালকে নিষ্কণ্টকভাবে দীর্ঘায়িত রাখার জন্য দেশীয় কর্মচারীদেরকে নানা বিধিবিধান ও আইনের দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্জীব অংশে পরিণত করে রেখেছিল। দেশ স্বাধীন হলেও উপনিবেশিক শাসকদের প্রবর্তিত ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত জগদ্দল পাথরের ন্যায় অপরিবর্তনীয় অবস্থায় রয়ে গেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে দেশের সব মানুষ এখনো শতভাগ শিক্ষিত নয়। জাতির যে অংশ জ্ঞান-বিজ্ঞান মেধা-মননে এবং শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগামী তারাই প্রজাতন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত থাকলেও জাতি বিনির্মাণে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখার স্থলে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণহীন ও নির্জীব অংশ হিসেবে নির্বাক থাকাই যেন তাদের ভূমিকা।
রক্ত দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর সমাগত। এখন আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয় হচ্ছে বিদ্যমান উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন।
বাংলাদেশে বিদ্যমান অপশাসনের অন্যতম উৎস হচ্ছে সংবিধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সংবিধানের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের যে অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে তা যদি সংবিধানের প্রতিটি ধারার বিষয়ে প্রয়োগ যোগ্য হয়ে ওঠে তাহলে অতি দ্রুত অপশাসনের অপসারণ শুরু হবে।
আজকে বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক মর্যাদা বিপন্ন করার বিরুদ্ধে যেভাবে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী বিভাগ এমনকি বিচার বিভাগ সোচ্চার হয়েছে তা অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য আশাবাদ সৃষ্টি করেছে। অন্যান্য জাতীয় প্রশ্ন যেমন জনগণের ভোটাধিকার, আইনের শাসন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সর্বোপরি জনগণের রাজনৈতিক মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিরন্তরভাবে সংবিধানের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে। তাহলে সামরিক অথবা অসামরিক কোনো সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ করেও সংবিধান লঙ্ঘন করে জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দুরূহ হয়ে পড়বে।
বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা হতে উপনিবেশিকতা উচ্ছেদ করতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে এবং তাহলেই অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক ও বিকশিত জাতি হিসেবে অত্র অঞ্চলে বাংলাদেশ উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
আমরা এখন সত্যি গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। এটা এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বিশ্বের শক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ততোধিক শক্তিধর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনার প্রতিক্রিয়ায় সেই দেশের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। আমাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সংবিধান রক্ষার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা আমেরিকার জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের সাম্প্রতিক প্রদত্ত ভাষণের সঙ্গে তুলনীয়।
The Joint Chiefs of Staff Chairman Mark Milley said the U.S. military did not take an oath to ‘an individual,’ but the Constitution, as President Donald Trump continued his reshuffle of the Pentagon in the wake of sacking Defense Secretary Mark Esper.
Delivering his remarks on Wednesday, Milley said: ‘We are unique among armies, we are unique among militaries. We do not take an oath to a king or queen, or tyrant or dictator; we do not take an oath to an individual. No, we do not take an oath to a country, a tribe or a religion.’
‘We take an oath to the Constitution, and every soldier that is represented in this museum— every sailor, airman, marine, coastguard— each of us protects and defends that document, regardless of personal price.’
অর্থাৎ সামরিক-অসামরিক কর্মচারীরা কোনো রাজা-রানী, স্বৈরশাসক বা ব্যক্তির আনুগত্যের লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ করে না, তারা শপথ গ্রহণ করে যেকোনো মূল্যে সংবিধান রক্ষার লক্ষ্যে।
বিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ বলেছিলেন, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর পদক্ষেপটি নেয়া, যার ভিত্তিতে উপনিবেশিকতা-পীড়িত মানুষ বিশ্ব নাট্যমঞ্চে তাদের হারানো কণ্ঠস্বরটি আবার ধ্বনিত করতে পারে, আওয়াজ তুলতে পারে প্রতিরোধের।
‘পরার্থপরতার যাত্রা শুরু নিজ গৃহ হতে’ অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সাংবিধানিক শাসনের যাত্রা শুরু করেছেন নিজ গৃহ থেকে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। এ থেকে বিচ্যুতি অনিবার্যভাবে আমাদেরকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করবে।
লেখক: গীতিকার
