যে ডাক্তার কাজ করে না, তার কোনো দোষ হয় না স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে– ‘চে–ই নাথিং, ডু নাথিং অ্যান্ড বি নাথিং’। একশটি কাজ করলে একটি ভুল হতে পারে। ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনারা (ডাক্তার) রক্ত মাংসের মানুষ। সামনে যাতে কোনো ভুল না হয় সেদিকে আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া বিএমএ নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ডাক্তারদের বাঁচানো নয়; তাদের যথাযথ ভাবে তদারকি করাই আপনাদের কাজ। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে দু’দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক কোলোরেক্টাল সার্জারি কনফারেন্স ও লাইভ ওয়ার্কশপ–২০১৮ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চমেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগ ও ভারতের দি অ্যাসোসিয়েশন অব কোলন ও রেক্টাল সার্জনস অব ইন্ডিয়া (এসিআরসিআই) যৌথভাবে কনফারেন্সটি আয়োজন করে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন মারা গেছেন। বছরে এরকম তিন থেকে চার হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে যায়। সেই হিসেবে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে বছরে গড়ে ৪ জন রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হন। এটা তো স্বাভাবিক।

জাহিদ মালেক আরো বলেন, আমি নিজেও একজন ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। চমেকে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাশও করেছিলাম। কিন্তু পড়া হয়নি। আমার ছোটবেলা কেটেছে এই চট্টগ্রামে। আমার বাবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। কাজেই এই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে। এজন্য যতটুকু সম্ভব আমি এ কলেজকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

চট্টগ্রামের বিএমএ’র নেতাদের উদ্দেশ্য করে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডাক্তারদের সাথে রোগীর স্বজন কিংবা কারো গণ্ডগোল হলে আপনারা তখন ছুটে যান। গণ্ডগোল থামানো কিন্তু আপনাদের কাজ নয়। আপনাদের কাজ হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা দেখা। এছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্সরা ঠিকমতো সার্ভিস দিচ্ছে কিনা তা তদারকি করা। হাসপাতালের সার্ভিস যাতে ভালো হয়, সেটিও আপনাদের দেখার বিষয়। আপনাদের কাছ থেকে একটি বিষয় পাইনি তা হলো– আপনাদের পরামর্শ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য বিভাগ অনেক দূর এগিয়েছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এমনকি প্রাইমারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে জাপানের চেয়েও আমরা বেশি পিছিয়ে নয়। আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমাদের লোকবল সংকট আছে। পাশাপাশি ডাক্তার ও স্পেশালিস্টও কম আছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকায় আমাদের দেশে চিকিৎসকরা চাপে থাকেন। তাদের চাপে থাকার বিষয়টি কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝে না। চমেক হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবা নিতে এসে যদি সিট না পায় এবং ফ্লোরে তাদের যদি সেবা দেওয়া হয় তখনও তারা চিকিৎসকদেরকে দায়ী করেন। বলা হয়, চমেক হাসপাতালে রোগীরা চিকিৎসাসেবা পায় না। সাধারণ মানুষের মনোভাব আমি বুঝি। তাদের প্রত্যাশাও আমি জানি। তারা মনে করে সৃষ্টিকর্তার পরেই চিকিৎসকদের স্থান।

তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের ব্যর্থতা আছে। কারণ হচ্ছে চমেক হাসপাতালে যে প্রয়োজনের তুলনায় শয্যার স্বল্পতা আছে তা আমাদের বেশি করে প্রচার করতে হবে। তখন হয়তো সাধারণ মানুষের মনে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। যেহেতু মানুষের মনোভাব আমি বুঝি তাই আমার ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেকটা সেতুর মতো।

চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে করে নাছির বলেন, আপনারা অনেক ভালো চিকিৎসাসেবা দেন। কেউ ইচ্ছে করেই রোগীকে ভুল চিকিৎসা দেয় না। এরপরও আপনারা আরেকটু আন্তরিকতার সঙ্গে রোগী দেখবেন। মনে রাখবেন আপনারা জেনেশোনে বিষপান করেছেন। সুতরাং চ্যালেঞ্জকে জয় করে এগিয়ে যেতে হবে।

চট্টগ্রাম বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী বলেন, কোনো রোগী মারা গেলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয়, ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গেছে। সম্প্রতি রাইফা নামে একটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলা হচ্ছে। ডাক্তাররা কি তাহলে সন্ত্রাসী? আমাদের চিকিৎসকদের ওপর যদি মামলার ভয়, কারাগারের ভয় থাকে, তাহলে চিকিৎসা সেবা কীভাবে দিব? দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই কর্তব্যরত চিকিৎসক–নার্সদের থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা তো আর ভিনগ্রহের প্রাণি না। তাদের ভুল হতে পারে! মাননীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আপনি আমাদের অভিভাবক। আপনার নেতৃত্বে আমরা চিকিৎসক সুরক্ষা আইন চাই। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে আমাদের চিকিৎসকদের ওপর হয়রানি হলে বিএমএ’র নেতা হিসেবে আমরা বসে থাকতে পারি না।

অনুষ্ঠানে অন্যদের বক্তব্য রাখেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. সেলিম মো. জাহাঙ্গীর, চট্টগ্রাম বিএমএ এর সভাপতি প্রফেসর ডা. মুজিবুল হক খান এবং অধ্যাপক ডা. সনোয়ার হোসেন।

এর আগে লাইভ ওয়ার্কশপে অপারেশন প্রদর্শন করেন ভারত থেকে আগত শুভ্র গাঙ্গুলি, অধ্যাপক ডা. অভিজিৎ চ্যাটার্জী, বাংলাদেশের অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন ঝন্টু, অধ্যাপক ডা. মো. ফজলুল হক এবং সহায়তায় ছিলেন সহকারী অধ্যাপক ডা. শ্রীকান্ত বণিক ও ডা. ইউনুস হারুন চৌধুরী। বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য ফ্যাক্যাল্টি সার্জনবৃন্দ প্রথমদিনে পায়ুপথের জটিল প্রকৃতির ফিস্টুলা, মলাশয় এবং বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারসহ মোট ৫টি রোগীর অপারেশন করেন এবং তা অডিটোরিয়ামে উপস্থিত চিকিৎসকদের সরাসরি সম্প্রচার করে দেখানো হয়। এছাড়া এই সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য বিশ্লেষণ, আধুনিক রোগী ব্যবস্থাপনা এবং বর্তমানে প্রচলিত ও অত্যাধুনিক অপারেশন পদ্ধতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়। শল্য চিকিৎসকবৃন্দ তাদের পারস্পারিক কাজের অভিজ্ঞতা কারিগরী দিক এবং অপারেশন পরবর্তী ফলাফল তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র উপস্থাপনা করেন অধ্যপক ডা. মাহতাব উদ্দিন হাসান, অধ্যাপিকা ডা. সাহানারা চৌধুরী এবং অধ্যাপক ডা. এস.এম আশরাফ আলী। বক্তরা পায়ূপথ, মলাশয় ও বৃহদন্ত্রের বিভিন্ন রোগ, রোগীদের ভোগান্তি এবং সর্বস্তরের চিকিৎসকদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে করণীয় বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন কনফারেন্স কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. নুর হোসেন ভূঁইয়া। ডা. তাহিরা বেনজীরের সঞ্চালনায় কনফারেন্সে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মতিয়ার রহমান খান।

উল্লেখ্য, আজ সকাল ৮টায় কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শুরু হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মহা হিসাব–নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. মুসলিম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এছাড়া চমেক হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগের প্রধানগণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা উপস্থিত থাকবেন।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031