শুরু থেকেই COVID-19 নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ থেকে মাঠ পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুরু থেকে যদি আমরা সংবাদ মাধ্যমে আসা খবরগুলো পর্যালোচনা করি কিংবা চিকিৎসকদের মতামত নেই তাহলে যে তথ্যগুলো বেড়িয়ে আসে তা হচ্ছে COVID-19 নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সমন্বয়হীনতা।

সবচেয়ে অবাক করা একটি বিষয় জাতি অবলোকন করল যে চিকিৎসকদের অনেকগুলো পরিচিত সংগঠন যাদের উপজেলা পর্যায়ে কমিটি ও লোকজন আছে তাদের কোন সহযোগিতা না নিয়ে Doctors for Covid-19 Solution নামে একটি সংগঠন গঠন করা হলো। যেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক (ডা.) সানিয়া তাহমিনা জোহরা স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ওই সংগঠনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, তাও আবার নতুন সংগঠনের প্যাডে। তাতেই স্পষ্ট COVID-19 নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ডাক্তারদের সাথে সমন্বয়হীনতা কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানেন না এ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সোমবার এক অভ্যন্তরীণ বৈঠকে বক্তব্য রাখার সময় তিনি নিজেই এ নিয়ে অভিযোগ করেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে চেয়ারম্যান করে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হলেও, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ের বাইরে আর কোন তথ্য কমিটির প্রধানকে জানানো হচ্ছে না বলে আক্ষেপ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। (বিবিসি বাংলা, ৬ এপ্রিল ২০২০)। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায় সমন্বয়হীনতা কোন পর্যায়ে।

এখন একটু পিছনে ফিরে থাকাই। ডিসেম্বর ২০১৯ এ চিনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হলেও এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। সংক্রমণ প্রতিরোধে কোন প্রস্তুতিই নেয়নি এমন কি এ ভয়াবহতা অনুধাবন করতেও অনেক বিলম্ব করে ফেলেছে। বিদেশী রাষ্ট্রদূত অথবা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যখন এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে ‘আমাদের সব ব্যবস্থা নেওয়া আছে।’ কিন্তু পরে আমরা দেখলাম এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।

৯ মার্চের মধ্যে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তা জানতে চান হাইকোর্ট। সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনায় ৫ মার্চ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ তিনটি মৌখিক নির্দেশনা দেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে- এ মর্মে প্রকাশিত সংবাদ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী আদালতের নজরে নিয়ে এলে উচ্চ আদালত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তিনটি মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

এগুলো হলো- এক. স্থলবন্দর, নৌ-বন্দর, বিমানবন্দর, বিশেষ করে বিমানবন্দরে যখন বিদেশিরা বাংলাদেশে আগমন করছেন, তখন অভ্যন্তরে প্রবেশের পূর্বে তাদের কি ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে, যারা পরীক্ষা করছেন তারা প্রশিক্ষিত কি না এবং যে যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেগুলোর সক্ষমতা রয়েছে কিনা তা জানাতে বলেছেন।

দুই. সারা বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা ভাইরাসের জন্য পৃথক কেবিনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন পর্যন্ত প্রাক প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয় নাই। আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি সব বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনা ভাইরাসের জন্য প্রাক প্রস্তুতিমূলক সব ধরনের ব্যবস্থা (পৃথক কেবিনসহ চিকিৎসকের সরঞ্জাম) গ্রহণ করতে হবে।

তিন. প্রত্যেকটি হাসপাতালে বা বন্দরগুলোতে যেখানে শনাক্তের জন্য করোনা ভাইরাস পরীক্ষার প্রয়োজন হবে সেখানে সরঞ্জামগেুলো পর্যাপ্ত রয়েছে কিনা, যদি না থাকে জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করার জন্য সরকারকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

কিন্তু আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সে পথে না হেঁটে নিজেদের মত করে হাঁটলেন। যার মূল্য এখন জাতিকে দিতে হবে। এখন হয়তো আর তেমন কিছুই করার থাকবে না।

মিডিয়ার খবর পর্যালোচনা করে ও ডাক্তারদের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি তা হচ্ছে- চিকিৎসকদের সাথে মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষ তেমন যোগাযোগই করেনি অথচ এ বিষয়ে তাদেরই প্রথম প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতার কারণে এ নিয়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে চিকিৎসকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি বলে মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ১ মার্চ অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে উপজেলা পর্যায়ে যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পর ২ এ রাখা হয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। যার পরের অবস্থানে অর্থাৎ ৩ এ আছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। চিকিৎসকগণ মনে করেন তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। তারা যেহেতু মূল দায়িত্ব পালন করবেন সেহেতু তাদের নাম ২ স্থানে থাকার দরকার ছিল।

আইইডিসিয়ার কোন সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়াই কার্যক্রম শুরু করে। চিকিৎসকগণ উন্নত বিশ্বের আদলে ও ডব্লিউএইচও এর নির্দেশনা মোতাবেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগ সেবা সংকোচিত করে এবং প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রাখে যা কর্তৃপক্ষ ভালভাবে নেয়নি। এতে উভয়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ৭ এপ্রিল সরকার প্রধানের একটি টেলি কনফারেন্সে চিকিৎসকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করায় পরিস্থিতি অরো জটিল হয়।

ডাক্তারদের অভিযোগ, ফুসফুসের লাস্ট স্টেজ ক্যান্সার আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে ভর্তি না করার কারণে জড়িত ডাক্তারদের শাস্তির কথা বলা হলেও একই সময়ে একজন ডাক্তারের মা জ্বর-কাশিতে ৫টি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের গেইটে এম্বুলেন্স এর মধ্যেই মারা যান, কিন্তু সেটা উল্লেখ করা হয়নি। চিকিৎসকরা মনে করেন কোন একটি পক্ষ বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চিকিৎসকদের সরকারের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে।

‘খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের পরিচালক ডা. এটিএম মোর্শেদকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। খুমেক হাসপাতালের চিকিৎসকদের মেয়াদোত্তীর্ণ সরঞ্জামাদি সরবরাহ করাকে কেন্দ্র করে আইইডিসিআর কর্মকর্তার সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের জের ধরে হাসপাতালটির পরিচালককে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত বদলিপত্র পৌঁছেছে খুলনায়। ’ (দৈনিক ইনকিলাব, ৩১ শে মার্চ ২০২০)। হাসপাতাল প্রস্তুতি, কিট ও টেস্টের স্বল্পতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে ফেলে। বিশ্বব্যাপী মাস্কের সংকট থাকায় অনেক হাসপাতালে N95 মাস্কের বদলে নিম্ন মানের কাপড়ের মাস্ক সরবরাহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের কথা N95মাস্ক না দেওয়া হোক অন্তত সার্জিকেল মাস্কতো দেওয়া যেত। আর ডাক্তারদের যে পিপিই প্রদান করা হয়েছে তা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করার মত মানসম্পন্ন নয়। এজন্য অনেকেই নাকি পরেন না। যা চিকিৎসাসেবাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ইতোমধ্যে ২৩ জন ডাক্তার আক্রান্ত, ৯২ জন কোয়ারেন্টাইনে আছে। এর মধ্যে ৩ জন আইসিইউতে আছে। ১ জন ডেন্টাল সার্জন ও একজন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট মারা গেছে। বিএসএমএমইউ এর ডারমাটলজির অধ্যাপক ও প্রাক্তন প্রো-ভিসিসহ অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।

দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে গার্মেন্টস শ্রমিকরা তাদের নিয়ে এক প্রকার তামাশা করা হয়েছে। কারণ ছাড়া কয়েক লাখ শ্রমিককে ঢাকা নিয়ে আসা হয়েছে। আবার তারা নিজ নিজ এলাকায় চলেও গেছেন। এর ফলে নারায়ণগঞ্জে কাজ করা শ্রমিকদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

COVID-19 ও অন্য রোগীদের একই হাসপাতাল সেবা প্রদান করা হলে ক্রস ইনফেকশনের মাধ্যমে ব্যাপক সংক্রমণ ঘটবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিবে।

সিলেটে একজন ডাক্তার রোগী দেখতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তার অবস্থার অবনতি হলো, প্রয়োজন আইসিইউ বেড। বিভাগীয় শহর সিলেটে তা পাওয়া গেল না। পরে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় এলেন। এতে সহজেই অনুমান করা যায় আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান কোথায়। বিভাগীয় শহরে যখন একজন ডাক্তার চিকিৎসাসেবা পান না সেখানে সাধারণ রোগীর কি অবস্থা হবে আর সবাইকে তো ঢাকায় এনে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না। অথচ উপজেলা সদরে না হোক অন্তত জেলা সদরে তো সেই ব্যবস্থা থাকা দরকারি ছিল, কিন্তু সাধারণ জনগণ বিভাগীয় পর্যায়ে এই সেবা পাচ্ছে না।

আর হ্যাঁ পরীক্ষার কিট, পরীক্ষাগার, পিপিই, আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটর- এগুলো সংগ্রহ, বৃদ্ধির কোনো দায়িত্বই ডাক্তারদের ছিল না। দায়িত্ব কার ছিল, কে বা কারা সে দায়িত্ব পালন করেনি? দায়িত্ব যদি ডাক্তারদের না থাকে তাহলে তাদেরকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কেন উপস্থাপন করছেন!

করোনা এ দেশে এসেছে বিদেশফেরতদের মাধ্যমে। সেখানে ডাক্তারদের কোনো দায়িত্ব ছিল না। দায়িত্ব ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, সরকারের। তাই দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে কাউকে প্রতিপক্ষ নয় বরং সরকার ও চিকিৎসকসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে। যে ডাক্তারদেরকে আমরা ফ্রন্ট-লাইন যোদ্ধা বলছি তাদের প্রতিপক্ষ না বানিয়ে এই মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বের করতে হবে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031