কলকাতায় আমাদের সেই পুরনো হালখাতার ছোট ছোট দোকানগুলো। চুল কাটার সেলুন। রেশন থেকে তুলে আনা গম ভাঙানোর ঘুম ঘুম দোকানগুলো। মুড়ি তেলেভাজার দোকান। পাঁউরুটি বিস্কুট মেম খায় কুটকুট সাহেব বলে ভেরি গুডের দোকান। আমাদের রাস্তাছোঁয়া মেজেনাইন ফ্ল্যাটের ঠিক নিচে তারাপদবাবু স্যাকরার দোকান। বাড়ির সামনেই ছোট্ট লেদ মেশিনের কারখানা, যেখানে বারো কি পনেরো জন মিস্তিরি কাজ করে, আর কী যেন সব তৈরী করে মেশিনে। আমাদের নিতাইদার সাইকেল সারানোর দোকান, যেখান থেকে সাইকেল ভাড়া করে চালাতে শিখেছিলাম।

ওদিকে মাণিকতলা বাজার, তার ভেতরে আর বাইরে নানারকম দোকান। ছোটবেলার ফুটবল ক্রিকেট খেলার বন্ধু কার্তিক পাল সেখানে ওদের চিঁড়ে বেসন মুড়কি ছোলাভাজার দোকানে এখন বসে ওর বাবা মারা যাবার পর। স্কটিশ ইস্কুলের আর এক বন্ধু যার সঙ্গে বুট পরে স্কুলের লীগে খেলতাম, সেই স্বপন সাহাদের কাঠচেরাইয়ের কল। ক্রিকেট খেলার রাইভ্যাল অসিত দাশ সরোজ দাশদের মিষ্টির দোকান যুগীপাড়ায়। এই প্রত্যেকটা দোকানে পয়লা বৈশাখ নববর্ষ হালখাতার কলাগাছ দেবদারু পাতা আর শোলার কদম ফুল দিয়ে সাজানো গণেশ পুজো এখনো পরিষ্কার মনে আছে।

যেন এই সেদিনের কথা।

কর্পোরেট আমেরিকার নিষ্ঠুর, মানবতা-ধ্বংসকারী অর্থনীতি ভারতবর্ষ প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করার পর এসব দোকানের অনেকগুলোই আস্তে আস্তে এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। এবারে বাকিগুলোও যাবে। আমাদের কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোও চলে যাবে। বিশাল হাউসগুলো যাবে না। বড় বড় সোনার গয়নার দোকান, সুপারমার্কেট, মল উঠে যাবে না।

ছোট ছোট রাস্তার দোকানগুলো শেষ হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে বৈঠকখানা বাজারের বই বাঁধানোর দোকানগুলো। যাবে হ্যারিসন রোডের ট্রামলাইনের ধারের বিয়ে আর অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ কার্ডের দোকানগুলো। চলে যাবে শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের মুখে বসা পরোটা, রুটি আর আলুর দমের সরু কাঠের বেঞ্চি পাতা দোকানগুলো।

শেষ হয়ে যাবে মঙ্গলবার বসা হাওড়ার মংলা হাট, রবীন্দ্র সেতুর ঠিক নিচে বসা ফুলের বাজার, বালিগঞ্জে রেল ব্রিজের তলায় চট পেতে বসা সন্ধের আবছা আলোয় গ্রামের দিদিদের লাউ, কুমড়ো, মোচা, জামরুল, থানকুনি পাতা বিক্রির পসরা। কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি নিয়ে কলকাতার বাজারে আর আসবে না। বংশীবদন না খেতে পেয়ে মরবে। ভাগ্নে মদন হারিয়ে যাবে কোথায়।

আরো কত দোকান, আরো কত ব্যবসা। আমার বন্ধুরাই অনেকে সেসব ব্যবসা গড়ে তুলেছে নিজের হাতে। যতটা পেরেছে সৎভাবে ব্যবসা করেছে এই দুর্নীতির যুগেও। চেষ্টা করেছে, কীভাবে গরিব কর্মচারীদের বিপদে আপদে তাদের পাশে থাকা যায়। এই নববর্ষের পরে আর তারা পারবে বলে মনে হয় না।

তাই বলছি “হয়তো এই শেষ নববর্ষ।” আমার জীবন সামনের পয়লা বৈশাখ পর্যন্ত থাকবে কিনা, সেটা বড় কথা নয়। আমার দেশটা, আমার বাংলা দেশটা, আমার চেনা দুঃখ চেনা সুখ চেনা চেনা হাসিমুখের কলকাতা শহরটা থাকবে কিনা, সেটা অনেক বড় প্রশ্ন এই ১৪২৭ বাংলা সনের পয়লা বৈশাখে।

আজকের করোনাভাইরাস সঙ্কট হয়তো এক মাস, দু মাস, কিংবা তিন মাস পরে একটু কমবে। মানুষ হয়তো আবার একটু একটু করে রাস্তায় বেরোবে। বাচ্চারা স্কুলে যাবে। প্রেমিক-প্রেমিকারা লেকের ধারে, কলেজ ক্যাম্পাসে, কিংবা রবীন্দ্রসংগীতের আসরে আবার একবার যাবে। হাত ধরবে। কিংবা …

এমনও হতে পারে, এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার “অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয়তা” — আর্জেন্ট নেসেসিটি দেখিয়ে শাসকশ্রেণী রবীন্দ্রজয়ন্তী, সভা সমাবেশ, মিটিং মিছিল, নাট্যোৎসব, চলচ্চিত্র সপ্তাহ, পৌষ মেলা, বারোয়ারি দোল দুর্গোৎসব, ঈদের মেলামেশা- সবকিছুই একটু একটু করে নিষিদ্ধ করে দেবে। শাসকযন্ত্রের মিডিয়া হিন্দিতে চব্বিশ ঘন্টা প্রচার করবে, বাঙালিরা কেন রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল মেলা, বাউল গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

সেখানে একটাই মুখ প্রতিদিন দেখা যাবে- সেই জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের বিগ ব্রাদারের মতো। এবং আমরা সকলেই শাসকশ্রেণী এবং তাদের মিডিয়া প্রোপাগাণ্ডা নিঃশর্তে মেনে নেবো। যে মানবে না, তার জন্যে নানা ব্যবস্থা থাকবে।

“এই হয়তো শেষ নববর্ষ” আমাদের, বাঙালি জাতির। বাংলাদেশে একরকম। পশ্চিমবঙ্গে আর এক রকম।

লেখক: আমেরিকা প্রবাসী

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031