প্রায় ১২০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন কারণে । এ কারণে চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক। এ ছাড়া প্রধান পোশাক  রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কম মজুরি, বিনা মজুরিতে কাজ করিয়ে নেয়া, প্রসূতিকালে চাকরিচ্যুত, ক্ষতিপূরণ না দেয়াসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে এ খাতটিতে। গতকাল টিআইবি’র ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে ‘তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন: অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য ওঠে আসে। এসব চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার পাশাপাশি টিআইবি তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীভূত তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে একক কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশসহ ৮ দফা সুপারিশ পেশ করে। একইসঙ্গে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০২ ডলার করারও প্রস্তাব করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক মো. ওয়াহিদ আলম উপস্থিত ছিলেন।

২০১৭ সালের মে থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এ গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমন্বিত উদ্যোগে তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এখনো ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন অংশীজন কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগসমূহের ৩৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হলেও ৪১ শতাংশ উদ্যোগের বাস্তবায়ন এখনো চলমান এবং ২০ শতাংশ উদ্যোগের বাস্তবায়ন স্থবির বা ধীর গতিতে হচ্ছে।

মালিকপক্ষ ব্যবসা টিকিয়ে রাখার ওপর গুরুত্ব প্রদানসহ রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিলেও শ্রমিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তাকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন না। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে আইনি সীমাবদ্ধতা এবং যৌথ দরকষাকষির পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির পাশাপাশি মালিক পক্ষের প্রভাব এখনো অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে, শ্রমিকের চাকরিচ্যুতিতে ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, সংগঠন করার অধিকার, মারাত্মক অসুস্থতার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। বায়ার প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শনকৃত অধিকাংশ কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও জাতীয় উদ্যোগের কারখানাসমূহে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

গবেষণায় দেখা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আইন, নীতি ও আইনের প্রয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, শুদ্ধাচার, জবাবদিহি, কারখানা নিরাপত্তা, শ্রমিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন অংশীজন কর্তৃক গৃহীত উল্লেখযোগ্য ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে ৪০টি বা ৩৯ শতাংশ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে, ৪২টি বা ৪১ শতাংশ উদ্যোগের বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে এবং ২০টি বা ২০ শতাংশ উদ্যোগের বাস্তবায়ন স্থবির বা ধীর গতিতে হচ্ছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অগ্রগতি হলেও ফায়ার স্টেশন নির্মাণ, পরিদর্শক নিয়োগ, অনলাইন সেবাসমূহ ব্যবহারবান্ধব করা ইত্যাদি বিষয়ে চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। সংশ্লিষ্ট আইনে মালিক ও শ্রমিকের অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংজ্ঞায়ন, কারখানাসমূহে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া এবং ধর্মঘট আহ্বানের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। অঙ্গীকার সত্ত্বেও সরকার এখনো শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ক আইএলও কনভেনশন (১২১) স্বাক্ষর করেনি। রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনার মামলায় বারবার শুনানির তারিখ পরিবর্তনের মাধ্যমে মামলার দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে আসামিদের গ্রেপ্তার এড়াতে সাহায্য করা হচ্ছে। রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন এবং স্পেক্ট্রাম ফ্যাশন গার্মেন্ট সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

১৪৭টি বিশেষজ্ঞ কারখানা পরিদর্শকের পদ এখনো শূন্য রয়েছে। উঁচু ভবনসমূহের অগ্নি নির্বাপণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্র-সামগ্রীর ঘাটতি থাকায় অগ্নি নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন নীতি-সহায়তা গ্রহণ সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যায় যে, সমপ্রতি প্রকাশিত শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় ২৬টি প্রতিষ্ঠানই তৈরি পোশাক খাতভুক্ত নিয়োজিত যা সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকার ও বায়ারদের সমন্বিত উদ্যোগ সত্ত্বেও এখনো ৯৮২টি বা প্রায় ৩২ শতাংশ পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তায় আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। আর্থিক সংকট, ভাড়া করা ভবনে কারখানা স্থাপন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা প্রভৃতি কারণে বিভিন্ন কারখানার সংস্কার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারখানা সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার ও বায়ার  উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়।

গবেষণায় দেখা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন কারণে প্রায় ১২০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে যার ফলে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। যদিও বিজিএমইএ’র তথ্য মতে ৭৭৮টি নতুন কারখানায় ৬ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আরসিসির সক্ষমতা নিরূপণের জন্য সমন্বিত পরিবীক্ষণ ব্যবস্থায় মালিক পক্ষের সংযুক্তিকরণ এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ না রাখার ফলে মালিক পক্ষের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে।

গবেষণায় অধিকাংশ ছোট ও সাবকন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোতে ন্যূনতম মজুরি প্রদান না করা, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির পর উৎপাদনের অতিরিক্ত টার্গেট নির্ধারণ, নিয়মবহির্ভূতভাবে মজুরি কর্তন, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪ ঘণ্টা করা, অনেক ক্ষেত্রে ৫-৬ ঘণ্টার অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় শ্রমিকদের কাজ করানো ইত্যাদি অনিয়মের তথ্য ওঠে এসেছে। পোশাক শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় সদস্য মনোনয়নের অভিযোগ রয়েছে। গবেষণায় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে শ্রম পরিদপ্তরের কোনো কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১০-১৫ হাজার টাকার নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। কারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পরিদর্শক কর্তৃক অভিযোগ তদন্তে কারখানার মালিকপক্ষের সামনে অভিযোগকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ফলে শ্রমিকের নিপীড়ন ও চাকরিচ্যুতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মালিকপক্ষ কাগজে-কলমে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি স্বীকার করলেও অধিকারের বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনার সময় তাদের মধ্যে শ্রমিক অধিকারসুলভ মানসিকতার ঘাটতি দেখা যায়। মুনাফা বৃদ্ধি, ব্যবসায়িক সুবিধা বজায় রাখা ও বিকাশ ঘটানোর দিকেই তাদের প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। আবার সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশকিছু অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও সেখানে প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের এখনো যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে না পারা অত্যন্ত উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি সরকার, মালিকপক্ষ এবং বায়ারদের একটি ত্রিমুখী ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে হলে অবশ্যই তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়ন করতে হবে। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সম্পর্কিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মজুরি কাঠামো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা বিবেচ্য। কম্বোডিয়ার বর্তমান ন্যূনতম মজুরি ১৯৭ ডলার। সে হিসেবে বাংলাদেশের বিবেচনায় আমরা ২০২ ডলার করার প্রস্তাব করছি।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, মালিকপক্ষ যা কিছুই করছেন সেটা তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। তৈরি পোশাক খাতে মালিকপক্ষের শ্রমিক অধিকারসুলভ মানসিকতার ঘাটতির কারণেই এখনো খাতটিতে সুশাসনের প্রকট ঘাটতি রয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই মনে করেন তৈরি পোশাক খাত তাদের নিজের প্রতিষ্ঠান। খাতটিতে মালিকদের স্বার্থের পাশাপাশি শ্রমিকদেরও ব্যাপক স্বার্থ রয়েছে। তাই উভয় পক্ষকেই তৈরি এ খাতের ওপর সুনজর দিতে হবে।

তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার, শ্রম মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক খাতের মালিক সংগঠন ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনের বিবেচনার জন্য সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে উত্থাপিত উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো, ন্যূনতম মজুরি ও সংগঠন করার অধিকারসহ আইনে প্রাপ্য শ্রমিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, সাব-কন্ট্রাক্ট ও ক্ষুদ্র কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে বিভিন্ন অংশীজনের অংশগ্রহণে একটি তহবিল গঠন এবং বিভিন্ন দুর্ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাসমূহের দ্রুত বিচার এবং শ্রম আদালতসমূহকে ট্রাইব্যুনালে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে মামলাসমূহের দ্রুত নিষ্পত্তি করা।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031