জাল স্ট্যাম্প (কোর্ট ফি) ব্যবহারের মহোৎসব চলছে উচ্চ আদালতে। প্রশাসনের নজরদারির আড়ালে বছরের পর বছর একটি সিন্ডিকেট এই জাল কোর্ট ফি সরবরাহ করে আসছে। আর জাল কোর্ট ফি ব্যবহারে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। তিন বছর আগেই এই জাল কোর্ট ফি ব্যবহারের বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের নজরে আসে। অবেশেষে অনেক চেষ্টার পর গতকাল বৃহস্পতিবার জাল কোর্ট ফি ব্যবহারের বিষয়টি হাতে-নাতে ধরা পড়ে।

গতকাল সকালে প্রাথমিক পরীক্ষায় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন দেখতে পান, ২১টি মোশন ফাইলের মধ্যে ২০টিতে ব্যবহৃত অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ কোর্ট ফি’র সবই জাল। এরপর প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আপিল বিভাগের অন্যান্য সব বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির সঙ্গে তাৎক্ষণিক বৈঠক করেন। বৈঠকের সুপারিশ অনুযায়ী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি বিশেষজ্ঞ টিম ডেকে আদালত চত্বরে অভিযান চালায় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। অভিযানে জাল কোর্ট ফি’সহ ২ জন ভেন্ডর (স্ট্যাম্প বিক্রেতাকারী এজেন্সির মালিক) ও একজন কোর্ট ফি সরবরাহকারীকে হাতে-নাতে গ্রেপ্তার করা হয়। পরীক্ষা করা হয় আরও কিছু ফাইল।

দেখা যায়, বেশিরভাগ ফাইলেই জাল কোর্ট ফি ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাকা এক বৈঠকে সুপ্রিমকোর্টের ৫টি ফাইল যাচাই-বাছাই করা হয়। এতে সব ফাইলেই জাল কোর্ট ফি ধরা পড়ে বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা।

গতকাল ধরা পড়েন শরিয়তপুরের জাজিরার বড়কান্দির দেলোয়ার হোসেন (৩৭) ও মনির হোসেন (৪০)। তারা ভেন্ডরের মালিক। এছাড়া সরবরাহকারী হিসেবে ধরা হয় কুমিল্লার তিতাসের স্বরসতিচরের বাসিন্দা জাকির হেসেনকে (৩০)।

জানা গেছে, যে স্ট্যাম্প সাধারণত বিচারিক কাজে ব্যবহার হয়, সেগুলোই জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প (কোর্ট ফি)। এটা সাইজে ছোট ও কম টাকার হয়ে থাকে। দুই টাকা, চার টাকা, পাঁচ টাকা, ১০ টাকা ও ২০ টাকার জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প দেখা যায়। অপরদিকে নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প সাধারণত সরকারি স্ট্যাম্প যা ১০০ টাকা, ৫০টাকাসহ বিভিন্ন মূল্যের হয়ে থাকে। এই স্ট্যাম্পের ওপর চুক্তিপত্র, জমি ক্রয় বা বিক্রয়ের কাজ বা বিভিন্ন দালিলিক কাজ করা হয়। সরকারি রাজস্বের অন্যতম উৎস এসব স্ট্যাম্প তৈরির আইনগত অধিকার রয়েছে বিজি প্রেস এবং সিকিউরিটি এন্ড প্রিন্টিং প্রেসের। কিন্তু অসাধু চক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাপাখানা স্থাপন করে এসব জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে থাকে।

জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার মামলা হয় সুপ্রিমকোর্টে। এছাড়া অনেক মামলার আদেশ ও রায়ের কপি সরবরাহ করা হয় বিচারপ্রার্থীদেরকে। এসব মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে এবং রায় ও আদেশের কপিতে জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া অধস্তন আদালতেও একইভাবে স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ফাইলে দেড়শ-দুইশ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পও ব্যবহৃত হয়। আর এই জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পগুলো জালভাবে তৈরি করে সরবরাহ করছে একটি অসাধু চক্র।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুপ্রিমকোর্টে এই জাল কোর্ট ফি অনেক কম দামে বিক্রি হয়। প্রথম সরবরাহকারীর কাছ থেকে একশ টাকার কোর্ট ফি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যায়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে এটি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়। আর এই কেনাবেচার সঙ্গে আইনজীবীর মহুরিরা বেশি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের অধস্তন পর্যায়ের কিছু কর্মীও এই জাল কোর্ট ফি ব্যবহারের চুক্তিতে নেমে পড়েন। আসল কোর্ট ফি চেনার তেমন কোনো উপায় না থাকায় এবং সঠিক তদারকির অভাবে এই জাল কোর্ট ফি’র ব্যবহার হয়ে আসছে বছরের পর বছর।

আড়াই থেকে তিন বছর আগে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্তমান রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী জাল কোর্ট ফি ব্যবহারের বিষয়টি জানতে পারেন। ওই সময় তার উদ্যোগে সিআইডি একটি অভিযানও চালায়। কিন্তু করোনাসহ নানা কারণে সেই উদ্যোগ অনেকটা ভেস্তে যায়। সর্বশেষ চলতি বছরের শুরুতে ফের উদ্যোগ নেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে দফায় দফায় চিঠি লেখেন এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে। একাধিকবার চিঠি লেখার পর গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরকে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫টি ফাইল নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়, ব্যবহৃত সবগুলো কোর্ট ফি’ই জাল। ওই বৈঠক থেকে জাল কোর্ট ফি’র ব্যবহার রোধে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।

পরে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের উদ্যোগে জাল কোর্ট ফি চিহ্নিতকরণ ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইস’ (স্ট্যাম্প ইউভি লাইট) কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বশেষ গত সপ্তাহে দুটি ডিভাইস সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের হাতে আসে। পরে সকালে পরীক্ষামূলকভাবে হাইকোর্টের মোশন বেঞ্চ থেকে ২১টি ফাইল আনা হয়। সবগুলো চেক করে ২০টি ফাইলে ব্যবহৃত কোর্ট ফি’র সবই জাল বলে ধরা পড়ে।

এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, সকালে ২১টি ফাইল পরীক্ষার পর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির মূল ভবনের চার তলায় এবং সড়ক ভবন এলাকার ভেন্ডরগুলোতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় সিআইডির বিশেষজ্ঞ টিমও উপস্থিত ছিল। অভিযানে তিনজনকে হাতেনাতে আটক করা হয়।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আটককৃতদের বিরুদ্ধে মামলা হবে এবং এই জালিয়াত চক্রের মূল খুঁজে বের করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতীতে যাদের ফাইলে জাল কোর্ট ফির ব্যবহার হয়েছে সেটাও প্রশাসন দেখবে। এজন্য আরও ইউভি লাইট কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

জানা গেছে, সারাদেশের আদালতে সরবরাহের জন্য আরও ২ হাজার ইউভি লাইট কেনা হবে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031