ব্রিকস-বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সংস্থা দু’টির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি এই দুটি সংস্থাকে তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শগুলো হলো—(১) মানসম্পন্ন ও টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া (২) প্রযুক্তির জন্য বৃহত্তর সহযোগিতা কর্মসূচি চালু এবং (৩) স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সংলাপের প্রক্রিয়া শুরু করা।  রবিবার ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সামিটে ভাষণকালে তিনি পরামর্শ দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিম্নআয়ের দেশগুলোর সুযোগ-সুবিধার দিকে বিশেষ নজর দিতে ব্রিকস নেতাদের  নজর দিতে হবে।’ ব্রিকস ও বিমসটেকের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার জন্য সুনির্দিষ্ট ৩টি পন্থা অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সহযোগিতার জন্য পারস্পরিক সম্ভাব্যতা ও যৌথ কর্মপন্থা নির্ধারণের এটাই সময়।’

শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নে আমাদের সব প্রচেষ্টা শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল।’ তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের যেকোনও কর্মকাণ্ডে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। এই সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদ দমনেও আমাদের হাত মেলাতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ও অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ফোরাম বিমসটেকের আউটরিচ সামিটে যোগ দিতে রবিবার গোয়ায় পৌঁছেছেন। তিনি ব্রিকস ও বিমসটেকের নেতৃবৃন্দকে একই টেবিলে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই দুই গ্রুপের মধ্যে সহযোগিতার লক্ষ্যে পারস্পরিক সম্ভাব্যতা ও যৌথ কর্মপন্থা আমরা কিভাবে নির্ধারণ করব, তার স্বাক্ষর রাখার এটা এক সুযোগ ও যথার্থ সময়।’

১৯৯৭ সালে বিমসটেক গঠনের উদ্দেশ্যে কথা উল্লেখ করে সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শেখ হাসিনা বলেন, ‘সম্ভাবনাময় বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়নে এই ফোরাম গঠন করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চল কৌশলগতভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগসস্থলে অবস্থিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এ অঞ্চলে রয়েছে কর্মক্ষম যুবশক্তি যা আগামী কয়েক দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিমসটেক অঞ্চলে ৩০০ গিগাওয়াটের বেশি হাইড্রোইলেকট্রিক এবং বঙ্গোপসাগরের বিপুল সমুদ্র সম্পদের সম্ভাবনা রয়েছে। এই সমুদ্র সম্পদের এখনো আহরণ ও বিশদ বর্ণনা তৈরি করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য আমরা রূপান্তরের এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ, উন্নয়ন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিমসটেক দেশগুলোর অর্থায়নে একই ধরনের সুযোগ রয়েছে। সম্ভাবনার সুযোগ গ্রহণে এবং আমাদের চ্যালেঞ্জ মেকাবেলায় ব্রিকস এবং বিমসটেক উভয়ের জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ‘

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিমসটেকের বৃহত্তম অংশের জন্য মানসম্মত ও স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন।  বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর প্রয়োজন এফডিআই থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ইকুয়িটি বিনিয়োগ এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন দেশব্যাপী একশত অর্থনৈতিক জোন (ইজেডএস) উন্নয়ন করছে। যা বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, ইলেকট্রনিক সিটির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে, সেখানে বিনিয়োগকারীরা বিপুল সম্ভাবনার সুযোগ নিতে পারে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সহায়ক আইন, ট্যাক্স হলিডে, রেয়াতি শুল্কে মেশিনারি আমদানি, রেমিটেন্সের নিশ্চয়তা, শতভাগ বৈদেশিক মালিকানা, আনরেস্টিকটেট এক্সিট পলিসি, মূলধন ও লভ্যাংশ নিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ সুরক্ষায় বাংলাদেশের উদার বিনিয়োগ নীতি রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি, আমাদের নীতিমালা এবং সুযোগ-সুবিধা প্রতিযোগিতামূলক এবং পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ও নীতি পরিবেশ সহায়ক।’

ব্রিকস কাঠামোর অধীনে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিন্ম আয়ের দেশগুলোর সম্ভাবনার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য ব্রিকস দেশগুলোর প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী সক্ষমতার উন্নয়নে বিমসটেক অঞ্চলের নজর দেওয়ার প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব এখন জ্ঞান অর্জনের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেছে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য চাষাবাদে প্রযুক্তি সুবিধা, পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন মেকাবিলায় আমাদের উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ করা প্রয়োজন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘ব্রিকস ও বিমসটেক টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে আলাপ-আলোচনায় যুক্ত হতে পারে। এটি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের প্রবণতা রীতির সঙ্গে আমাদের মূল্য ও বাজার সমতার সংযোগের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে।’

এর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত পারসেকারের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। ব্রিকস ও বিমসটেক নেতাদের সম্মানে এ মধ্যাহ্ন বোজের আয়োজন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী ২০০৪ সালে আলোচিত বিমস্টেক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পন্ন করার জন্য নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এফটিএ বাস্তবায়নের পক্ষে আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। কারণ এতে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে এবং বিমস্টেক কর্মকা- বৃদ্ধি পাবে। আগামী বছর বিমস্টেকের ২০তম বার্ষিকীতে এফটিএ সম্পর্কিত ৪টি চুক্তি চূড়ান্ত অনুমোদনের লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করতে পারি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত ২০ বছরে আমাদের দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগে আমরা অগ্রগতি অর্জন করেছি। তবে অগ্রগতি মন্থর হলেও আমরা গ্রাউন্ডওয়ার্ক সম্পন্ন করেছি। এখন সময় এসেছে এ প্রক্রিয়াকে সংহত করা।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিমস্টেককে কিভাবে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে চাই, এখন তা চিন্তা করার সময় এসেছে। বিমস্টেকের আওতায় আমরা ১৪টি সহযোগিতার খাত চিহ্নিত করেছি। আমি মনে করি আগামী ৫ বছর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জ্বালানি, যোগাযোগ এবং সন্ত্রাস দমনের মতো বিষয়গুলোর প্রতি আরো বেশি আলোকপাত করা দরকার। এজন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ খাতে নিয়মিত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক জরুরি।’

আঞ্চলিক পরিবহন যোগাযোগ প্রক্রিয়া দ্রুত করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এডিবি’র সক্রিয় সহযোগিতায় পরিবহন যোগাযোগ সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখবে।’

যোগাযোগ সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিমস্টেক একটি উপকূলীয় জাহাজ চুক্তির কথা বিবেচনা করতে পারে।’ তিনি সুষ্ঠু উপ-আঞ্চলিক গ্রিড সংযোগ ও জ্বালানি বাণিজ্যের স্বার্থে অবিলম্বে গ্রিড ইন্টারকানেকশন সংক্রান্ত একটি এমওইউ স্বাক্ষরের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন।

সন্ত্রাসের বিষয়ে বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সন্ত্রাস ও সহিংসতা দমনে বিমস্টেকের মধ্যে আমাদের সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।’ সূত্র: বাসস

 

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031