‘বিএনপি প্রধান বিরোধী দল না’ ইদানীং এ কথাটা আমার কাছে কেমন যেন প্যারাডক্সের মতন ঠেকে। তার আগে বলি প্যারাডক্স কী জিনিস। প্যারাডক্স হচ্ছে দর্শন এবং যুক্তিবিদ্যার একটা বিশেষ হেঁয়ালির নাম। প্যারাডক্স মানে এমন বাক্য যার অর্থ সম্পর্কে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না। অনেকটা ধাঁধাঁর মতন একটা জিনিস, যার মূল ব্যাপারটা হলো কথার প্যাঁচ। কিন্তু ধাঁধাঁর যেমন একটা উত্তর থাকে, একটা সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়, প্যারাডক্সের সেরকম কোনো কূল কিনারা নেই। প্যারাডক্সকের ব্যাখ্যায় এটা হলো অল্পকথার সহজ উত্তর। প্যারাডক্স নিয়ে সক্রেটিসের উদাহরণ আছে একটা, জগদ্বিখ্যাত। ‘আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না’- এই বাক্যটা একটা প্যারাডক্স। কেউ যদি বলে ‘আমি জানি’ তাহলে পরের অংশ ‘কিছুই জানি না’ কথাটা ভুল। আবার সে যদি ভাবে ‘কিছুই জানি না’ কথাটা সঠিক, তাহলে ‘আমি জানি’ বাক্যের এই অংশটা ভুল। এই মারাত্মক মারপ্যাচে শেষ পর্যন্ত আসলে বোঝা যায় না যে বক্তব্যের কোন অংশটাকে ঠিক বলে ধরা যাবে। দর্শন আর যুক্তিবিদ্যার ভাষায় এ ধরনের প্যারাডক্সকে বলে ‘লায়ারস প্যারাডক্স’। এর আরেকটা ক্ল্যাসিক উদাহরণ হলো ‘এই বাক্যটি মিথ্যা।’ ব্যাখ্যা প্রায় একই রকম, বাক্যটি যদি মিথ্যা হয় তাহলে কি বাক্যটি আদৌ সত্য? কিন্তু বাক্যটি বলছে বাক্যটি মিথ্যা, তাহলে সেটা সত্য হবে কী করে? অনেকটা সেই আগের উদাহরণের মতোই প্যাঁচালো ব্যাপার।
এবার প্রসঙ্গে আসা যাক। বিএনপি নামক বাংলাদেশের এককালের পরাক্রমশালী অথচ বর্তমানে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রায় হিমশিম খাওয়া, রাজপথ থেকে হারিয়ে যাওয়া, সরকারের উপুর্যপরি ‘চড় থাপ্পড়ে’ কোণঠাসা একটা রাজনৈতিক দলের সাথে প্রাচীন গ্রিক দর্শনের একটি জটিল ধারণা ‘প্যারাডক্স’ এর কী সম্পর্ক? সম্পর্ক হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি বর্তমানে যে ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু প্যারাডক্সটা কী? সেটা অনেকটা এরকম- ‘বিএনপি বিরোধী দল না।’ আমরা এই প্যারাডক্সকে বলতে পারি ‘দি বিএনপি প্যারাডক্স।’
বাংলাদেশের বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের হিসেব নিকেশে বিএনপি বিরোধীদল না। এটা না মানার কোনো উপায় নেই। তার কারণ কাগজে কলমে, নিশিতে জাগরণে বিরোধী দল হল জাতীয় পার্টি। এদিকে জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রধান এরশাদ আবার সরকারপ্রধানের বিশেষ দূত। ক্যাবিনেটে গোটা তিনেক মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীও আছে জাতীয় পার্টির। মূলত হালুয়া রুটির ভাগ নেয়া ছাড়া জাতীয় সংসদে এই প্রধান বিরোধী দলের বা তার এমপি-মন্ত্রীদের আর কোনো ভূমিকা আছে বলেও মনে হয় না। সরকার আর বিরোধী দলের এরকম মিলেঝিলে একান্নবর্তী কেবিনেট বানানোর নজির পৃথিবীতে কয়টা আছে আমার ঠিক জানা নেই। তো এরকম একটা গোলমেলে সম্পর্কের মধ্যেও যদি বলি জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল তাহলে ভুল বলা হয় না।
মুশকিল হলো, আমিতো বলি, আপনিও শোনেন, সরকারও বলে, আমরাও শুনি। কিন্তু জন কেরি তো শোনে না। শি জিনপিং তো শোনে না। তারাতো দেখি উল্টো কথা বলে। কারণ যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে অন্য দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি এলে নিয়ম হলো সরকার প্রধান আর বিরোধী দলের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং বৈঠক করেন।
জন কেরি বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করলেন আর দেখা করলেন বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। যদিও সেসময় কেরি খুবই কৌশলে রাজনৈতিক আলাপ এড়িয়ে গেছেন। মানে খালেদা জিয়া আসল কথা বলার সুযোগই পাননি।
মজার ব্যাপার হলো সেসময় কেরি রওশন এরশাদের সাথে দেখা করলেন না। তাকে একটা ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে রওশন এরশাদ দুই মিনিট তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার সুযোগ পান। তখন এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেত, কেরি কেন আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলের প্রধানের সাথে কথা বললেন না? অন্তত তাতে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের খেলাপ হয় কি না, সে প্রশ্নও তোলা যেত। কিংবা আরেকটু ‘বেয়াদবি’ করে জানতে চাওয়া যেত তিনি আকারে ইঙ্গিতে এটাই বুঝিয়ে দিলেন কি না যে জাতীয় পার্টিকে সংসদের প্রধান বিরোধী দল বলে মানেন না। কেউ এ প্রশ্ন তোলেনি। তাই আমরা কোনো সাফ-সুতরো উত্তরও পাইনি।
সেই একই ঘটনার পুনারাবৃত্তি হলো এবার, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সাম্প্রতিক সফরের সময়। চীনের প্রেসিডেন্ট ভারত যাওয়ার ফাঁকে দেড় দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে এসে, গাদাখানেক চুক্তি সই করে গেলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে তিনিও দেখা করলেন, বৈঠক করলেন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। রওশন এরশাদের সাথে বসলেন না।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দুই দুইবার প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে। এখন এই দুই রাষ্ট্রীয় অতিথি যদি তার সাথে সেজন্য সৌজন্য সাক্ষাৎ করতেন তাহলে হয়তো এ প্রশ্নটা উঠতো না। কিন্তু তারা দুজনেই যখন সচেতনভাবে রওশন এরশাদকে এড়িয়ে যান তখন এমন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক- বিএনপিই কি তাহলে বাংলাদেশের বিরোধী দল?
যদি উত্তরে বলেন ‘বিএনপি বিরোধী দল না’ তাহলেই ‘দি বিএনপি প্যারাডক্স’ এর সূচনা হবে।
বিএনপি বিরোধী দল না এটা সরকার বলছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও বলছে, আবার কথায় বার্তায় আকারে ইঙ্গিতে এটাও বুঝিয়ে দিচ্ছে তোমরাই কিন্তু আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্বরাজনীতির প্রতিনিধিরাও দেশে এসে প্রধান বিরোধী দলের মতোই বিএনপিকে তোয়াজ করছে। তাহলে সোজাসাপ্টা বলে দিলেইতো হয়, সংসদে না থাকলেও বিএনপিই বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল। এই নাম না নেয়ার ‘ভাসুর’ ‘ভাসুর’ সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাটাই কি ভালো না? প্যাঁচটাই বা খেলছে কে আর ধোঁকাটা কে কাকে দিচ্ছে বলেনতো?
লেখক: গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ।
