দেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাংলাদেশকে যাতে ‘আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন’ বা সালিশির একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ‘আরবিট্রেশন’ নিয়ে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিয়ে প্রধান বিচারপতি সিনহা বলেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া এক্ষেত্রে খুব বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আর সেখানে দিল্লি বা ঢাকার মতো শহরের বিরাট সম্ভাবনা আছে।’
গত রবিবার ২৪ অক্টোবর আয়োজিত ওই সেমিনারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তিরথ সিং ঠাকোর ও ভারতের বহু নীতি-নির্ধারক উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে আরবিট্রেশন বিরোধ নিষ্পত্তির একটি স্বীকৃত পদ্ধতি, যাতে প্রচলিত আইন-আদালতের শুনানির চেয়ে সাধারণত অনেক কম সময় লাগে। বাদী-বিবাদী দুপক্ষের খরচও অনেক কম হয়।
বস্তুত ভারত-বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশ-মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে তাদের সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি করেছিল জাতিসংঘের সমর্থিত আরবিট্রেশন বা ‘আনক্লসে’র মাধ্যমেই।
বাণিজ্যিক বা করপোরেট ক্ষেত্রে আরবিট্রেশনের একটি কেন্দ্র হিসেবে এশিয়াতে ইতোমধ্যেই সিঙ্গাপুরের বেশ নামডাক হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলো যেমন- দিল্লি, ঢাকা, কলম্বো বা কাঠমাণ্ডু এ ক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছিয়ে।
এ ঘাটতি পুষিয়ে নিয়ে ভারত যাতে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের একটি কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, সে জন্যই উদ্যোগ নিয়েছে ভারতের সাবেক পরিকল্পনা কমিশন। আর ঠিক সেখানেই বাংলাদেশকেও জুড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন বিচারপতি সিনহা।

দিল্লিতে পরে এক একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘দেখুন, আমাদের দেশে আরবিট্রেশন আইন বেশ শক্তিশালী। উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তুলতে পারলে সিঙ্গাপুরের মতো ঢাকারও একটি স্বীকৃত আরবিট্রেশন সেন্টার না-হয়ে উঠতে পারার কোনও কারণ নেই।’

ভারত এ ব্যাপারে যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়ে বিচারপতি সিনহা আরও বলেন, ‘ধরুন, একটা আরবিট্রেশনে দশটা শুনানি হলো। এখন এমন একটা ব্যবস্থা হতেই পারে, যেখানে আটটা শুনানি করা হলো দিল্লিতে, আর দুটো ঢাকায়। সে ক্ষেত্রে ভারতের এ পদক্ষেপে আমরাও লাভবান হবো।’

বস্তুত শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই আইনি দীর্ঘসূত্রিতা যথেষ্ট পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ না আসার একটা বড় কারণ। বিদেশি কোম্পানিগুলো যখন দেখে এ অঞ্চলে একটা করপোরেট বিরোধের মীমাংসা হতে আদালতে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়, স্বভাবতই তারা সেখানে লগ্নি করতে নিরুৎসাহিত বোধ করে।

আরবিট্রেশন এ সমস্যার একটা বিরাট সমাধান হতে পারে। মূলত বিদেশি বিনিয়োগ টানার জন্যই কিন্তু ভারত নিজেকে আরবিট্রেশন সেন্টার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। আর তাতে এখন সক্রিয়ভাবে সামিল হতে চায় বাংলাদেশও।

মাত্র মাসকয়েক আগেই নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে সার্ক দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিরা একটি সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। কাঠমাণ্ডুতে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আরবিট্রেশন সেন্টার গড়ে তোলার জন্য তখন তারা সই করেছিলেন একটি সমঝোতাপত্রেও।

কাঠমাণ্ডুর সেই সম্মেলনে ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি আনওয়ার জাহির জামালিও। কিন্তু সম্প্রতি ইসলামাবাদে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হওয়ার পর সেই প্রস্তাব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এমন কি সার্কের ভবিষ্যতও প্রশ্নের মুখে।

এতে অবশ্য হতাশ হওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। বরং তিনি বলছেন, ‘পাকিস্তানকে যদি নাও পাওয়া যায়, তারপরও আরবিট্রেশনের কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান তো একসঙ্গে এগোতেই পারে!’

‘আর শুধু বিবিআইএন-ই বা কেন, এ উদ্যোগে সামিল হতে পারে আফগানিস্তান বা থাইল্যান্ডও।’ যোগ করেন বিচারপতি সিনহা।

প্রধান বিচারপতি পদে নিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই রাজধানী ঢাকাকে আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের সেন্টার হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে, এ প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন তিনি।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031