দুপক্ষই নিজ নিজ বক্তব্যের বিষয়ে জোরালো তথ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করছে । ঘটনা একই। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পৃথক দুই ইউনিটের বক্তব্য দুরকম। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, কার তথ্য সঠিক? এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুসংস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আলোচনা-সমালোচনা চলছে মানুষের মুখে মুখে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টির দ্রুত সুরাহা হওয়া উচিত। একই ঘটনা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুপক্ষের দুরকম বক্তব্যের কারণে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে। জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। এতে করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখবে সবাই।

গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেল্লা। ঘটনার প্রায় ৯ মাসের মাথায় চলতি বছরের ২৭ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অভিযোগপত্রে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এমএ কাইয়ুমসহ সাত জন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। বাকিরা হলেন, কাইয়ুমের ভাই আব্দুল মতিন, তামজিদ আহমেদ ওরফে রুবেল ওরফে শুটার রুবেল, রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল, মিনহাজুল আরেফিন রাসেল ওরফে ভাগনে রাসেল, শাখাওয়াত হোসেন শরিফ ও সোহেল ওরফে ভাঙ্গারী সোহেল।

চার্জশিট দেওয়ার প্রায় চার মাসের মাথায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, সিজার তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে নিও জেএমবি জড়িত। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘নিও জেএমবির হাতে সিজার তাভেল্লা খুন হয়েছেন। নিও জেএমবির বাংলাদেশ প্রধান সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ওরফে আবু ইব্রাহীম আল হানিফের বাসা থেকে এ সংক্রান্ত নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সিজার তাভেল্লা ছাড়াও আরও ২২টি হামলা সংক্রান্ত নথি উদ্ধার হয়েছে।’ যদিও অন্যান্য ঘটনার মতো সিজার তাভেল্লার হত্যার দায়ও স্বীকার করেছিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট। সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।

সিজার তাভেল্লা হত্যায় নিও জেএমবি জড়িত বলে র‌্যাবের দাবির পর এই নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। বুধবার সেই দাবি উড়িয়ে দিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি সিজার তাভেল্লা হত্যা মামলার একজন তদারক কর্মকর্তাও ছিলেন। মনিরুল ইসলামের দাবি, ‘ফৌজদারি মামলার তদন্ত আসলে পরিচালিত হয় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। এখানে রচনা বা ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক করার কোনও সুযোগ নেই। সিজার তাভেল্লা হত্যা মামলাও ফৌজদারি কার্যবিধির সব নিয়ম মেনেই তদন্ত করা হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে একদল পেশাদার অফিসার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাহায্য করে তদন্ত সম্পন্ন করেছেন। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে।’ মনিরুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনার আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার কাজও শুরু হয়েছে। কোনও দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারেন না বলেও জানান তিনি।

শুধু সিজার তাভেল্লা নয়, আব্দুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান নামে যাকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে নিও জেএমবির বাংলাদেশ প্রধান আবু ইব্রাহীম আল-হানিফ বলে দাবি করা হয়েছে, তাও নাকচ করে দিয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট- সিটিটিসি। সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন,তাদের তদন্তে সারোয়ার জাহান নিও জেএমবির তৃতীয় সারির একজন নেতা বলে উঠে এসেছে।গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর ইমিডিয়েট পরের নেতা সারোয়ার জাহান।

ইতালিয় নাগরিক সিজার তাভেল্লার হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে র‌্যাব ও ডিবির দুরকম বক্তব্যে সৃষ্টি  হয়েছে বিভ্রান্তিইতালিয় নাগরিক সিজার তাভেল্লার হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে র‌্যাব ও ডিবির দুরকম বক্তব্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি

এমনকি গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় তামিম চৌধুরীর আস্তানায় অভিযান চালানোর সময় সে বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, তারা হলো তানভীর কাদেরী ও মেজর জাহিদ। এবং তামিমের আস্তানা ঘেরাও করা হয়েছিল ভোর ৬টার দিকে। বুধবার এই দাবি করেছেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। অপরদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে তামিমের সঙ্গে আব্দুর রহমানের যোগাযোগের যে নথি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা ২৭ আগস্ট রাত ২টা ২৩ মিনিট থেকে ৩৯ মিনিট পর্যন্ত সময়ের। সিটির দাবি অনুযায়ী রাত ২টা ২৩ থেকে ৩৯ মিনিট পর্যন্ত তামিমের আস্তানা ঘেরাও করাই হয়নি। ফলে তার ঘেরাও বিষয়ে কথা বলার কোনও সুযোগই নেই।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘একই ঘটনা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুসংস্থার দুরকমের বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি করছে। এসব বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।’ তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সংস্থার মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত। আর যে কোনও বক্তব্য দেওয়ার আগে তা যাচাই-বাছাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে দেওয়া উচিত।’

নূর খান লিটন বলেন, ‘তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটে অনেক দুর্বলতা ছিল। এখন র‌্যাব আবার নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে। এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। আমি মনে করি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তদারক করা উচিত।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল অব. আব্দুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একই বিষয়ে দুই সংস্থার দুই রকম বক্তব্যে বোঝা যায় যে, তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাজ করছে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য বিভ্রান্তি তৈরি করছে। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সমন্বয় কাউন্সিল রয়েছে। এতে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণ থাকে। তারা নিজ নিজ সংস্থার তথ্য কাউন্সিলের বৈঠকে শেয়ার করে এবং তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর তা ডিসক্লোজ করে থাকে। বাংলাদেশেও এ ধরনের সমন্বয় কাউন্সিল গঠন করা প্রয়োজন। এটা না করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বাড়তেই থাকবে। এ ধরনের কাজ রাষ্ট্রের দায়িত্ব ।রাষ্ট্রকেই এটা করতে হবে।’

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031