এত্ত গরমেও মানুষ থাকে!

ডানাকিল মরুভূমি। ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া সীমান্ত এই মরুভূমিতেই পড়েছে। ইথিওপিয়া-জিবুতি সীমান্তও ওখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। তবে মরুভূমিটার প্রায় পুরোটাই পড়েছে ইথিওপিয়ার ভেতরেই। গড় তাপমাত্রার হিসাবে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম অঞ্চল। গড় তাপমাত্রাই ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা প্রায়ই ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। বৃষ্টির দেখা পাওয়া এখানে ভাগ্যের ব্যাপার। জায়গাটার ডাকনামই হয়ে গেছে ‘নরকের দুয়ার’। অথচ এমন গরম অঞ্চলেও নাকি মানুষ থাকে! কেবল থাকেই না, ওরা ডানাকিল মরুভূমিতে বাস করে আসছে বংশানুক্রমে, হাজার বছর ধরে। ডানাকিল মরুভূমির এই আদিবাসীদের নাম ‘আফার’।

এই ডানাকিল মরুভূমি রীতিমতো এক প্রাকৃতিক বিস্ময়। কেউ যদি এমন গরমের সঙ্গে যুদ্ধ করে মরুভূমিটার মাঝখান পর্যন্ত যেতে পারেন, সারা জীবন গল্প করার মতো স্মৃতি নিয়েই ফিরে আসবেন। সে জায়গাটা এমন, মনেই হবে না পৃথিবীর কোনো জায়গা। মনে হবে, চাঁদে নয়তো মঙ্গলে চলে এসেছেন। অদ্ভুত পাথুরে ভূমি, তাতে নানা বর্ণ। নানা খনিজ লবণের নানা রং আর কি। মরুভূমিজুড়েই আছে এসব খনিজ পদার্থ। তার মাঝে কোথাও গ্যাসের বুদ্বুদ উঠছে। কোথাও বা এসিডের ছোটখাটো একটা পুকুর। অনেক জায়গায় আবার লাভা টগবগ করে ফুটছে। হ্যাঁ, ডানাকিল মরুভূমিতে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। এগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। কয়েক হাজার বছর ধরে এই আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে লাভা বের হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে দুটি আগ্নেয়গিরি বিখ্যাত। যেটি বেশি পুরনো, সেটির নাম আয়ালু। অন্যটির নাম আর্ত আলে। সব মিলিয়ে জায়গাটা এখনো হাজার বছরের পুরনো পৃথিবীর চেহারায়ই আছে।

এই ডানাকিল মরুভূমি কেবল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চলই নয়, নিচু ভূমিও। এর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকেও ১০০ মিটার নিচে। ধারণা করা হয়, হাজার হাজার বছর আগে ইথিওপিয়ার নিচে যে টেকটোনিক প্লেটগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে একটা বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। তাতেই এ অঞ্চল নিচে নেমে যায়। সম্ভবত অঞ্চলটি একসময় সাগরের নিচেই ছিল। পরে সাগর সরে যায়। এই সাগর অবশ্য ওখানকার খনিজ লবণের উৎস নয়। এমনকি আওয়াশ নদীও নয়। এই আওয়াশ নদী ইথিওপিয়ার অন্যতম প্রধান নদী। সে দেশের রাজধানী আদ্দিস আবাবার কাছের এক পাহাড় থেকে নদীটির উত্পত্তি। তারপর ছুটে গেছে ভারত মহাসাগরের দিকে। কিন্তু সে পর্যন্ত যেতে পারেনি। তার আগেই ডানাকিল মরুভূমিতে এসে কয়েকটা লবণের লেক

তৈরি করে থেমে গেছে।

ডানাকিল মরুভূমির এই খনিজ লবণগুলোর উৎস আসলে লোহিত সাগর। লোহিত সাগরের পানি একটা স্রোতের মতো আসতে থাকে এখানকার মাটির নিচ দিয়ে। মরুর মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে অন্যদিকের মাটির চাপে সেটি থেমে যায়। তখন সেই লবণাক্ত পানি আগ্নেয়গিরির লাভা তো বটেই, মাটির ফাঁকফোকর দিয়েও ওপরে উঠতে থাকে। অবশ্য এমন গরমে পানির ওপর পর্যন্ত আর ওঠা হয় না। ওপরে এসে জমে কেবল লবণ। ওই লবণই এখানকার এমন ভিনগ্রহের মতো চেহারার মূল কারণ।

লবণই এখানকার আদিবাসী আফারদের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে দেয়। আফাররা এখনো তাদের পুরনো নিয়মেই জীবন যাপন করে। অবশ্য এখন আর তারা আগের মতো বুনো নেই। একসময় তো তারা বাইরের মানুষদের সহ্যই করত না। অবশ্য এখনো তারা দেশ-বিদেশ-সীমান্ত—অতশত বোঝে না। তাদের এলাকায় তারা নিজেদের মতো করেই থাকে। আর লবণ তুলে তুলে ফেরি করে বেচে। এই লবণ বেচেই তাদের আয়রোজগার হয়। দল বেঁধে আফাররা ডানাকিল মরু থেকে খনিজ লবণ তোলে। ঠিক তোলে বলা যায় না, ওরা আসলে লবণ কাটে। সেখানে বিভিন্ন খনিজ লবণের বিশাল বিশাল চাঁই আছে। চাই থেকে কেটে কেটে ওরা লবণ নেয়। তারপর তাদেরই আরেক দল লবণগুলো আশপাশের বিভিন্ন লোকালয়ে গিয়ে বিক্রি করে আসে। আর এসব কাজে তাদের প্রধান সঙ্গী উট।

অবশ্য ওরা প্রকৃতিগতভাবে পশু পালন করে। মানে ওদের সমাজ মূলত পশু পালনকারী সমাজ। আফাররা স্বভাবে ভীষণ সাহসী আর স্বাধীনচেতা। তাই বোধ হয় ওরা এই ডানাকিল মরুতে থাকতে পারে। না হলে যে জায়গার ডাকনামই হয়ে গেছে ‘নরকের দুয়ার’, সেখানে কি মানুষের পক্ষে থাকা সম্ভব!

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031