সমাজপতিরা টাঙ্গাইলের গোপালপুরে তৃতীয় শ্রেণির প্রতিবন্ধী এক ছাত্রীর ধর্ষণের বিচার হিসেবে ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে রায় দিয়েছেন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতিবন্ধী ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে হারুন মেকার (৫০) নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় প্রভাবশালীদের চাপের মুখে আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি অসহায় পরিবারটি।

জানা যায়, সমাজপতিদের চাপের মুখে প্রথমদিকে পরিবারটি ধর্ষণের বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখলেও ধর্ষণের ঘটনা চাপা না থাকায় গত ১৮ অক্টোবর লোক দেখানো একটি গ্রাম্য সালিশ হয়। সালিশে ধর্ষককে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তারপরও টাকা পরিশোধে টালবাহানা করে ধর্ষক হারুন মেকার। পরে ৫ নভেম্বর মেয়ের পালক বাবাকে ৪০ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন সমাজপতিরা।

সরেজমিনে গোপালপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম চাঁনপুর। এ গ্রামের হতদরিদ্র একটি পরিবারের পালক সন্তান ধর্ষণের শিকার ওই প্রতিবন্ধী শিশুটি। দু’চালা একটি টিনের ঘরে তাদের বসবাস। বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করতেই প্রতিবন্ধী মেয়েটি ভয়ে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।  মেয়েটির মা জানায়, ওই ঘটনার পর থেকে অপরিচিত যেকোনও পুরুষ  মানুষ দেখলেই ভয় পায় শিশুটি। বাড়ির অদূরে একটি মাঠ পাড়ি দিয়ে পাশের সাহা পাড়া মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত সে। মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তৃতীয় শ্রেণির গন্ডি পেরোতে পারেনি। তবে থেমে থাকেনি তার স্কুলে যাওয়া-আসা। অন্যদের তুলনায় বয়সে একটু বড় হলেও স্কুলে সহপাঠী ছোট ছোট শিশুদের সঙ্গেই খেলা করতো। ওই ঘটনার পর থেকে স্কুলে আর না গেলেও অজানা কারণে প্রতিদিনের হাজিরা খাতায় রয়েছে তার নাম। ধর্ষণের ঘটনা ও স্কুলে উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে কোনও কথাই বলছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ চিত্র সারা এলাকা জুড়েই। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হালিমুজ্জামান তালুকদার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় ঘটনা সম্পর্কে সবাই অবগত হলেও তার ভয়ে মুখ খুলছেন না কেউ।

ঘটনার বিষয়ে মেয়েটির মা বলেন, ‘মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় তাকে নানাভাবে চিকিৎসা করানো হচ্ছে।  ঘটনার দিন তার বাবা বাড়ি ছিলো না। এ খবর জেনে বাড়িতে আসে পূর্ব পরিচিত কামাক্ষা গ্রামের হারুন মেকার। মেয়েটিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে চান তিনি। প্রথমে রাজি হইনি। অনেক জোরাজুরি ও মেয়েটির কোনও ক্ষতি হবে না অভয় দিলে রাজি হয়ে স্কুল থেকে এনে তার হাতে তুলে দেই। তিনি মেয়েটিকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে নিয়ে মুখে গামছা বেঁধে অত্যাচার করেন। পরে মেয়েটি বাড়িতে এসে সব ঘটনা খুলে বলে।’

এ বিষয়ে মেয়েটির বাবা বলেন, ‘আমি বাড়ি ছিলাম না। বাড়ি এসে সব শুনে গ্রামের লোকজনদের জানাই। আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে তারা আমাকে নিষেধ করে এবং বিচারের আশ্বাস দেয়। পরে ১৮ অক্টোবর শালিসে ওই সিদ্ধান্ত হয়। সবাই আমাকে মেনে নিতে বলে আমি বাধ্য হয়ে তা মেনে নেই। পরে ৫ নভেম্বর ওই টাকা হাতে পাই।’

এ ব্যাপারে জানতে পাশের কামাক্ষা গ্রামের অভিযুক্ত হারুন মেকারের বাড়িতে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকলে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। পরে চতুর হারুন মেকার সাংবাদিক পরিচয় ও হাতে ক্যামেরা দেখে নিজেকে  বৃন্ত নামে পরিচয় দিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান।

এ বিষয়ে হারুন মেকারের পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চাইলে তারা ক্ষিপ্ত আচরণ করে বলেন, ‘ঘটনা যা হয়েছিল তা মিমাংসা হয়ে গেছে।’

এ বিষয়ে মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি স্থানীয় ইউপি সদস্যের কাছ থেকে জানতে পেরেছি একটি বৃদ্ধ লোক ওই মেয়েটির শরীরে হাত দিয়েছে। পরে এ নিয়ে ঝামেলা হলে ইউপি সদস্য মোনায়ের মাধ্যমে ৪০ হাজার টাকায় তা সমাধান করা হয়েছে।’

গায়ে হাত দিলে ৪০ হাজার টাকা কেন জরিমানা দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান।

এ বিষয়ে গোপালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি অবগত হলাম। এর মধ্যে যতোটুকু জেনেছি তারা আমাদের অগোচরে ও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউপি সদস্য মোনায়ের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে টাকার বিনিময়ে আপোষ রফা করেছে।’

তিনি আরও বলেন, মেয়েটির পরিবার নিরীহ ও হারুন মেকার প্রভাবশালী হওয়ায় তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছি। তদন্ত করে সব রকমের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুমূর রহমান বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে এইমাত্র অবগত হলাম। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গোপালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031