কথা ছিল আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ভারত সফর করবেন,  তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে তখনই হয়তো একটা ‘বড় ঘোষণা’ আসবে। ভারতের মধ্যেই নানা পর্যায়ে সেই লক্ষ্যেই আলোচনা এগোচ্ছিল বেশ মসৃণ গতিতে। কিন্তু রাতারাতি পাঁচ শ’ ও হাজার রুপির নোট বাতিল করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাটকীয় ঘোষণা সেই রাজনৈতিক অঙ্ককে হঠাৎ জটিল করে তুলেছে।

এর কারণ হলো, তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে যার সম্মতি ভীষণ জরুরি, সেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ারপারসন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নোট বাতিল ইস্যুতে সরাসরি মোদির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ফেলেছেন।

সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে তাকে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। এদিন তৃণমূল কংগ্রেসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এই প্রতিবেদককে জানায়, ‘এই ইস্যুতে তৃণমূল নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর ওপর এতটাই চটেছেন যে, তিস্তা নিয়ে যাবতীয় অগ্রগতি যদি তিনি ভণ্ডুল করে দেন, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!’

কিন্তু কেন তিস্তা নিয়ে এই আশা ও আশাভঙ্গের দোলাচল, তা বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে গত কয়েক সপ্তাহের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির দিকে।

১৫ অক্টোবর: গোয়ায় ব্রিকস ও বিমস্টেক আউটরিচের অবকাশে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেই শেখ হাসিনা ডিসেম্বরে তার ভারত সফরের ব্যাপারে নীতিগতভাবে রাজি হয়ে যান। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ভারতের মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য’ তৈরির কাজ যে খুব ভালোভাবে এগোচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির এই সুস্পষ্ট আশ্বাসই ছিল তার সম্মতি দেওয়ার প্রধান কারণ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র তখন জানিয়েছিল, ‘এটা বুঝতে হবে শেখ হাসিনা যে এতদিন পর ভারত সফরে রাজি হয়েছেন, সেটা নিশ্চয় তিস্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর তিনি বিরাট ভরসা করছেন বলেই!’

জুন-অক্টোবর: পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে তৃণমূল কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফেরার পর গত পাঁচ- ছ’মাস ধরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে গোপনে আলোচনা চালাচ্ছিল কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যের জন্য নানা বিশেষ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, আংশিক ঋণ মওকুফ ও প্যাকেজের বিনিময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তিস্তা নিয়ে সুর নরম করতে অনেকটাই রাজি হয়েছিলেন। এই ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের একজন সিনিয়র এমপি।

২৫ অক্টোবর: দিল্লিতে সেদিন প্রধানমন্ত্রী মোদি বৈঠক করেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের সঙ্গে। তিস্তা নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে বিশদে আলোচনা হয়। তিস্তার উৎপত্তি সিকিমেই। সে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি চামলিংকে কথা দেন তিস্তার উজানে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধনে তিনি এ বছরের মধ্যেই সিকিমে যেতে রাজি। কিন্তু বিনিময়ে চামলিংকেও তিস্তা চুক্তিতে সমর্থন জানাতে হবে। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী তাতে সায় দেন সানন্দেই।

৮ নভেম্বর: শেখ হাসিনার আসন্ন সফরের রূপরেখা স্থির করতে সে দিনই দিল্লিতে আসেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। ওই দিন  তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয় ভারতের কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শশী শেখরের সঙ্গে। চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমকে রাজি করানোর প্রক্রিয়া কিভাবে এগোচ্ছে, তা নিয়ে শহীদুল হককে ব্রিফ করেন ভারতের জলসম্পদ সচিব। (সে দিন রাতেই গোটা ভারতকে চমকে দিয়ে দিয়ে নোট বাতিলের ঘোষণা করেন নরেন্দ্র মোদি। তবে তার দু’দিন পর শহীদুল হক যখন ঢাকা ফেরেন তিস্তা নিয়ে ‘মুড’ কিন্তু তখনও ভীষণই ইতিবাচক!)

১৩ নভেম্বর:  মোদির ঘোষণার পুরো পাঁচদিন পরও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা রংপুর সফরে এসে বলেন, ‘তিস্তার পানি-সমস্যার শিগগিরই সমাধান হবে বলে তিনি আশা করছেন। এর কিছুদিন আগে শ্রিংলার সঙ্গে বৈঠকের পর একই ধরনের আশা প্রকাশ করেছিলেন আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছিলেন শেখ হাসিনার সফরেই তিস্তা নিয়ে ‘ইতিবাচক সমাধান’ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু এর মধ্যে কলকাতায় নোট বাতিল নিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। সারাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন। এর মধ্যে দু’দফায় দিল্লি এসে রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি নালিশ জানিয়ে এসেছেন, সরকারকে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন, রাজধানীর যন্তর-মন্তরে বিক্ষোভ সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন ‘হিটলারের চেয়েও বেশি বাড় বেড়েছে’। মমতা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন দেশজুড়ে অন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে।

ফলে নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ব্যক্তিগত দূরত্ব যে কতটা বেড়েছে, তা বোঝাই যাচ্ছে।  আর এখন এর মূল্য চুকিয়ে দিতে হতে পারে তিস্তার জল ভাগাভাগিকে।

গত কয়েকমাস ধরে তৃণমূলের হয়ে যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ রাখছিলেন, রাজ্যসভায় দলের সেই সিনিয়র এমপি এদিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নোট বাতিলের ইস্যুতে সাধারণ মানুষের বিপুল দুর্ভোগের পরও কেন্দ্র যেমন জেদ ধরে আছে, তাতে তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎই বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মোদি সরকার মুখ্যমন্ত্রীর একটা ন্যায্য দাবিও মানবেন না, অথচ আশা করবেন দেশের স্বার্থে তিনি জল ভাগাভাগিতে রাজি হয়ে যাবেন—এটা তো হতে পারে না!’

তবে এমনটাও হতে পারে, নোট বাতিলের ইস্যুতে কেন্দ্রের সঙ্গে দর কষাকষির জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তাকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। শেখ হাসিনার সফর যখন এত এগিয়ে এসেছে, তখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের স্বার্থে দিল্লি তৃণমূলের দাবি কিছুটা অন্তত মেনে নেবে। সম্ভবত এমনটাই তিনি আশা করছেন।

সে যাই হোক, নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই নোটযুদ্ধ মাত্র দু’সপ্তাহ আগেও যার কোনও অস্তিত্ব ছিল না, তা যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে অগ্রগতির আশায় কালো মেঘের ঘনঘটা নিয়ে এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই!

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031