বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের যানজট পেরিয়ে কমপ্লেক্সে প্রবেশ করতেই গাড়ি নিয়ে বিপত্তিতে পড়েন তিনি। শিক্ষক দিদারুল আলম শুক্রবার ছুটির দিনে নির্মল আনন্দের আশায় পরিবার নিয়ে গেছেন চান্দগাঁও স্বাধীনতা কমপ্লেক্সে।
কমপ্লেক্সের পার্কিংজুড়ে বস্ত্রমেলার বিশাল প্যান্ডেল থাকায় গাড়ি রাখেন রাস্তার পাশে। কমপ্লেক্সের ভেতরে দরবার হলে গিয়েও হোঁচট খান আবারও। সেখানে পিকনিক আয়োজনের কারণে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। ঘুরতে গিয়ে দেখেন রাইডে রাইডে কপোত-কপোতির অশ্লীল যৌনতা। সে কি দৃশ্য-রে বাবা, চোখে দেখা যায় না। শেষমেশ কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। এমন বর্ণনা দিলেন শিক্ষক দিদারুল আলম।
তিনি জানান, নানা অনিয়ম ও অরাজকতা বিরাজ করছে নগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র স্বাধীনতা কমপ্লেক্সে। কর্তৃপক্ষের অতি বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে দর্শণার্থীরা প্রতিনিয়ত এ সমস্যায় পড়ছেন। এমন অভিযোগ অনেকের।
সরেজমিনে দেখা যায়, তাঁতবস্ত্র মেলার আড়ালে ঢেকে গেছে স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। নগরীর চান্দগাঁওয়ে কমপ্লেক্সের সামনে গাড়ি রাখার স্থান দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মেলার বিশাল প্যান্ডেল ও দোকান। কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কমপ্লেক্সের ভেতরের দরবার হলটিও। এসব প্রতিবন্ধকতায় নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিনোদন পিপাসুরা।
নানা অনিয়ম নিয়ে অসন্তোষ খোদ কমপ্লেক্সে কর্মরতদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, স্বাধীনতা কমপ্লেক্সের সামনের মাঠ ও গাড়ি রাখার স্থানে মেলার বিশাল প্যান্ডেলে বসিয়ে বছরজুড়ে বস্ত্র মেলা চলছে। এতে গাড়ি রাখতে ভোগান্তিতে পড়েন দর্শণার্থীরা। ঘূর্ণায়মান হোটেল এ-ওয়াচ টাওয়ারের এলুমিনিয়ামের প্যানেলগুলো খুলে পড়লেও দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে।
শিক্ষক দিদারুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, যে কোন বিনোদন কেন্দ্রের আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়। বিনোদন কেন্দ্রের যেখানে সেখানে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও মেলা চলতে থাকলে আকর্ষণ থাকে না। কমপ্লেক্সে ভেতরে দরবার হলে বিয়ে ও পিকনিক করলে হৈ-চৈ বেশি হয়। নির্মল পরিবেশ থাকে না। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে আলাদা করে একান্তে বেড়ানো যায় না।
তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া এমিউজমেন্ট পার্ক চালানো অত্যন্ত কঠিন। মূলত রাজনৈতিক প্রভাবে সিন্ডিকেট করে যারা বিভিন্ন পার্ক লিজ নেয় তাদের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা খুব কম থাকে। তারা বিনোদন বাড়ানোর পরিবর্তে অতি মুনাফা লাভের দিকে মনোনিবেশ করেন বেশি। তিনি বলেন, বিশ্বমানের কমপ্লেক্স করলে মানুষের আকর্ষণ যেমন বাড়বে, তেমনি মুনাফাও হবে বেশি।
প্রসঙ্গত, নগরীর চান্দগাঁও কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সংলগ্ন প্রায় ১৬ দশমিক ৩৭ একর জায়গাজুড়ে ২০০৬ সালে শহীদ জিয়াস্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিওটি পদ্ধতিতে এটি নির্মাণ করে কনকর্ড। চুক্তি অনুযায়ী কনকর্ড ২০০৯ সাল পর্যন্ত পার্কটি পরিচালনা করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে পার্কটি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে লিজ নেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)।
স্বাধীনতা কমপ্লেক্সের ইজারাদার মেসার্স ওয়েল এন্টারপ্রাইজ এর প্রোপ্রাইটর মো. হেলাল উদ্দিন। বর্তমানে তিনিসহ ১০জন মিলে এ কমপ্লেক্স পরিচালনা করছেন। কমপ্লেক্সের সামনে বস্ত্র মেলার কারণে দর্শনার্থীর গাড়ি রাখার তেমন সমস্যা হয় না দাবি করে তিনি বলেন, মেলার সামনে গাড়ি রাখার আরো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। সেখানে দর্শণার্থীরা গাড়ি রাখছেন।
কমপ্লেক্সের দরবার হলকে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হলটি আলাদাভাবে কাউকে ভাড়া দেয়া হয় না। কোনো প্রতিষ্ঠান কমপ্লেক্সে পিকনিকে আসলে তাদের রান্নার জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতা কমপ্লেক্সটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারহীন হয়ে পড়ে থাকায় প্রতœতাত্তি¡ক রেপ্লিকাগুলো অনেকটা আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে। রং উঠে রেপ্লিকাগুলোতে ধরেছিল শ্যাওলা এবং রাইডগুলো জং ধরে অকেজো হয়ে পড়ে। এতে অনেক রেপ্লিকা ও রাইড নষ্ট হয়ে যায়।
এছাড়া নষ্ট ছিল কমপ্লেক্সের শহীদ মিনারের পানির ৫টি ফোয়ারা। পুরো পার্কে কোন লাইটিং ব্যবস্থা ছিল না, ঝর্ণাটিও ছিল বন্ধ, পার্কের ভেতরে খাবারের কোন ব্যবস্থা ছিল না, বসার জায়গাগুলো ব্যবহার অনুপযোগী ছিল। এ অবস্থায় লিজ নেয়ার পর ব্যাপক সংস্কার কাজ করে স্বাধীনতা কমপ্লেক্সটি চালু করি। এতে আমাদের বিশাল একটি খরচ হয়। এরপরও যাতে দর্শণার্থীদের আকর্ষণ বাড়ে সেভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কমপ্লেক্সে সপ্তাহের ছুটির দিন শুক্রবার ও জাতীয় দিবসগুলোতে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্বাধীনতা কমপ্লেক্সে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনার আদলে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সোনা মসজিদ, আহসান মঞ্জিল, কার্জন হল, লালবাগ কেল্লা, শহীদ মিনার, কান্তজির মন্দির, বড় কুঠি, ছোট কুঠি, দরবার হল, সেন্ট নিকোলাস চার্চ, হাইকোর্ট, পাহাড়পুর বিহার, চিরন্তন পল্লীসহ উল্লেখযোগ্য দর্শণীয় স্থান। এছাড়া চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত¡া এবং বিভিন্ন জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে ২৪তলা বিশিষ্ট ঘূর্ণায়মান হোটেলের সাথে ওয়াচ টাওয়ার ও এমিউজমেন্ট রাইড, প্যাডেল বোট, ফ্যামিলি কোস্টার, বেবি ক্যাসেল, বেলুন হুইল, মিউজিক সুইং, বা¤পার কার, আরবি ট্রেন ইত্যাদি।
কিন্তু দর্শণার্থীদের অভিমত, বাইরের কোনো পর্যটক চট্টগ্রামে আসলে এ জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি স¤পর্কে সহজে জানার সুযোগ খুব কমই রয়েছে। এই এমিউজমেন্ট পার্ক সে সুযোগ করে দিতে পারে। এ পার্কের মাধ্যমে চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সহজে তুলে ধরা যায়। পার্কের বিশেষ একটি কর্নারের মাধ্যমে বৃটিশবিরোধী যুদ্ধের চিত্র, স¦াধীনতা ঘোষণার চিত্র, চট্টগ্রামের নামকরা স্থাপনা, আঞ্চলিক গান, এখানকার ঐতিহ্য সা¤পানসহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা যেতো। একইসাথে রেস্টুরেন্টে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানী মাংস, শুটকিসহ বিভিন্ন খাবারও পরিবেশন করলে পার্কের আকর্ষণ আরো বাড়তো।
জানা যায়, বর্তমানে স্বাধীনতা পার্কে প্রবেশ ফি নেওয়া হয় ১০০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য ইভেন্ট প্যাডেল বোট ৩০ টাকা, আরবি ট্রেন ৫০ টাকা, ফ্যামিলি কোস্টার ৪০ টাকা, বেবি ক্যাসেল ২০ টাকা, বেলুন হুইল ৩০ টাকা, বা¤পার কার ৫০ টাকা, মিউজিক সুইং ২০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। তবে আগে ২৪তলা বিশিষ্ট ঘূর্ণায়মান হোটেল দর্শনে জনপ্রতি ৭০ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও বর্তমান ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান কোন ভাড়া নেয় না।
স্বাধীনতা কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, কমপ্লেক্সে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ দর্শণার্থী আসেন। দর্শনার্থী বাড়াতে এ কমপ্লেক্সে আরো নতুন নতুন রাইডস আনার প্রক্রিয়া চলছে।
