১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ শুধু ভাষণ মাত্র নয়- বাঙালির সংগুপ্ত আশা-আকাক্সক্ষার স্বপ্নময় ব্যাকরণ ও কাব্যিক স্ফুরণে সমৃদ্ধ শাশ্বত কবিতাও।
বাংলার জমিনে হাজার বছর ধরে দিগ্বিদিক হেঁটে চলা বাঙালিদের শেষ পদচিহ্নটি ‘মুরজ মুরলী বীণা’র ঐকতান-ঝংকারে প্রথমবারের মতো মিশেছিল রেসকোর্সের বিশাল মানবিক উদ্যানে।
যেখানে সেদিন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের সংগুপ্ত প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দ্রুতি, ক্ষোভের স্ফুরণ-জাগরণ এবং বেঁচে থাকার মন্ত্রবীজ মুক্তি ও স্বাধীনতার অজস্র শব্দ-ব্যালেরিনা।
লক্ষ প্রাণের আকাঙ্খার যে কাব্যিক প্রণোদনাময় শব্দগুচ্ছ বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন তাতে পাল্টে গিয়েছিল বাংলা ও বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাসের দৃশ্যপট ও চিন্তার ভূগোল। পুরো জাতির কণ্ঠধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর বিশ্বাস আর প্রত্যয়মাখা প্রদীপ্ত বচনের অগ্নিময়-উত্তাপে। ফলে ৭ মার্চের ভাষণ শুধু রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে নয়; মুক্তি-অভিমুখী সব বাঙালির শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত করেছিল সংহত ও অবিচ্ছিন্ন মুক্তিপাগল-রক্তকণা।
যাতে করে নিরস্ত্র বাঙালি শক্তি ও সাহসের দৃঢ়তায় পাকিস্তানি সশস্ত্র সৈন্যদের বিরুদ্ধে মুহূর্তেই হয়ে ওঠে মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ানক এক আতঙ্কের নাম।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যুগপৎভাবে কবিতা ও ভাষণের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী অনুপম শিল্পপ্রতিমা। হৃদয়ানুভূতি, বুদ্ধিদীপ্ততা ও অভিজ্ঞতার সার্থক সংশ্লেষে এবং সমকালের সঙ্গে সর্বকালের অদৃশ্য রাখিবন্ধনে জন্ম হয় যে কবিতার, তার অনেক প্রবণতা লক্ষ করা যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে।
তাই ‘বাঙালির মুখবন্ধ’ হিসেবে পরিচিত এই ভাষণকে অনেকেই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেছেন ‘রাজনীতিক কবি’ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত নিউজ উইক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় বলা হয়, ‘তিনি রাজনীতিক কবি- প্রকৌশলী নন; তবে বাঙালিরা যত না প্রায়োগিক, তার চেয়ে শৈল্পিক বেশি। কাজেই এই অঞ্চলের সব শ্রেণি ও মতাদর্শকে ঐক্যবদ্ধ করতে যা প্রয়োজন, তাঁর রীতিতে হয়ত ঠিক তাই আছে।’
নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতিতুলনা করে বঙ্গবন্ধুকে ‘কবি’ আর তাঁর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘অমর কবিতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতায় বাক্যবন্ধ উচ্চারণে কবিতার যে সংজ্ঞার্থ নিরূপণ করেছেন তা দ্বারা উপর্যুক্ত বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। কবিতায় কবি বলেন, ‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা/… দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্র উদ্ভাসন কবিতা/ রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।/… সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা/ সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা/ জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা/ রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।’- বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্কাঠামোতে বিকীর্ণ হয়ে আছে কবিতায় প্রদত্ত উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ।
‘সেরা শব্দসমূহের শ্রেষ্ঠ বাণীবিন্যাস’ (Best words in the best order) কবিতার যে নির্মাণকলা তারই শিল্পিত প্রকাশভঙ্গি ছিল বঙ্গবন্ধুর কাব্যিক প্রণোদনাময় ভাষণটি। জলপ্রপাতের মতো সেদিন বঙ্গবন্ধুর ‘বজ্র উদ্ভাসন’ কণ্ঠচূড়া থেকে শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতধারায় গড়িয়ে পড়েছিল শব্দঝরনা হয়ে; বাক্যকল্লোলে বেয়ে বেয়ে।
বঙ্গবন্ধু যেন অনেকদিন থেকে শব্দকে পুষেছেন, বড় করেছেন- সময়মাফিক স্তরে স্তরে সাজিয়ে শব্দ-ফুলের মালা গেঁথেছেন আর তাতে শব্দমাত্রা ভাষামাত্রা পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে কাব্যমাত্রায়। বঙ্গবন্ধুর সুর ধীরে ধীরে গদ্য কবিতার মতো চড়া হতে থাকে। আবেগ আর ‘কনটেন্টে’ তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘টেস্টামেন্ট’ আর এভাবেই সেদিন বঙ্গবন্ধু কাব্যিক স্ফুরণে সত্য ভাষণ আর প্রতিরোধের উচ্চারণে ব্যক্ত করেন বাঙালির হাজার বছরের রাজনীতিক ও মানবিক মুক্তির আকাক্সক্ষাময় ধ্রুপদি ভাষ্য ‘অমর কবিতা’।
তাই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ যখন তার কবিতার শেষ স্তবকে বলেন,- ‘আমরা কি তার মতো কবিতার কথা বলতে পারব/ আমরা কি তার মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারব।’ তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ‘অমর কবিতা’ খ্যাত ধ্রুবসত্য রূপটি।
অল্প কথায় বেশি বলার নান্দনিক শিল্পবৈশিষ্ট্য কবিতার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি মূল প্রবণতা- তার সফল প্রকাশভঙ্গিও পরিলক্ষিত হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে। মাত্র কয়েকটি বাক্যে তিনি ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনের পর্যালোচনা করেছেন এবং ব্যক্ত করেছেন ‘বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার’ ক্রমিক ইতিহাসও। তাই এক হাজারেরও কিছু বেশি শব্দের এই ভাষণে বাক্যের পুনরাবৃত্তি নেই; আছে ভাবের পুনরাবৃত্তি- যার নাম মুক্তিকামিতা, আপসহীনতা সর্বোপরি স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্নীল আকাঙ্খা।
মজবুত গাঁথুনি আর নিটোল সংহতিতে জোড়া লাগানো প্রাঞ্জল-গতিময় ভাষ্যের প্রতিটি শব্দ দেশের স্বাধীনতা-উন্মুখ প্রত্যেক মানুষের মনে সঞ্চার করেছিল প্রাণস্পর্শী ব্যঞ্জনা। প্রতিটি মানুষ ভিন্নভাবে ভাষণের একেকটি শব্দ ও বাক্য হৃদয়ঙ্গম করলেও তাদের উপলব্ধির গভীরতা ছিল অভিন্ন চেতনাশক্তি দ্বারা প্রাণিত ও চালিত।
ফলে শুধু রক্তক্ষয়ী সময়বৃত্তে নয়, যুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত বাস্তবতায়ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিকামী জনতার অনন্ত প্রেরণা উৎসমূলÑ ক্ষত সারানোর অব্যর্থ মলম, নব-নির্মাণযজ্ঞে মেতে ওঠার প্রাণশক্তি।
সাহিত্য তথা ললিতকলা কী, এর উদ্দেশ্য কী এই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধে বলেন, ‘ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা।… সাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া সেই উপায়েই তাহাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।’
বঙ্গবন্ধু কর্মনৈপুণ্যের সঙ্গে সেই কাজটি তাঁর জীবনের প্রতিটি পদে, বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণে করতে পেরেছিলেন। ভাষণের শুরুতেই তিনি উচ্চারণ করেন, ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি।’
এভাবে লক্ষ লক্ষ অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা এবং নিজের একান্ত অভিব্যক্তিকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছেন বলেই তিনি রাজনীতির এক ‘অমর কবি’, তাঁর সময়ের মুখ্য কথক, প্রভাবশালী নিয়ামক।
‘জাগিয়া উঠিল প্রাণ’- সহসা উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের যেমন নির্ঝরের স্বপ্ন ভাঙে, আর সেই প্রাণের স্পর্শে পরশ পাথরের মতো সোনালি হয়ে ওঠে হাজার বছরের বাংলা-ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, তেমনি ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুও তাঁর উদাত্ত-কণ্ঠে কাব্যিক প্রণোদনায় স্থিতধী রাজনীতিক কবির ন্যায় মনন ও প্রজ্ঞার যৌক্তিক অবয়বে ‘গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে’ উচ্চারণ করেন-
‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’র মতো ঐশী বাণী। তাঁর ‘স্বপ্নোত্থিত মহাকাব্যিক’ এই আহ্বানে সেদিন ভেঙে যায় বাংলার মানুষের হাজার বছরের নিদ্রাচ্ছন্ন ঘুম, দ্বিধা-সংকোচ, ভয়-ডর। যার অনিবার্য পরিণতি বাংলার কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা, বাঙালির নিজস্ব ভূখ- ও স্বতন্ত্র মানচিত্র।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির যে কাব্যিক পদাবলি উচ্চারণ করেন, তাকে তত্ত্ব বা তাত্ত্বিকতার সীমিত পরিধিতে সীমাবদ্ধ করা যাবে না; পুরোপুরি কাঠামোবদ্ধ করা যাবে না হয়ত প্রথাগত কাব্যিকতার ‘ব্যাগেজে’ও।
এখানে যা আছে তা হলো বাঙালির হাজার বছরের রাজনীতিক আকাক্সক্ষা ও চিরকালীন মানবিক-মুক্তির সমন্বিত কাব্যিক প্রণোদনাময় কণ্ঠধ্বনি। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল জনমানুষের অন্তরের কথকতা। কবিতার মতো যার আবেদনÑ স্থায়ী, শাশ্বত ও চিরন্তন।
ইমন সালাউদ্দিন : গবেষক এবং শিক্ষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
