এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন চার লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায়ের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, তাকে বেশ চ্যালেঞ্জিং বলছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন । এক লাখ কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি মোকাবেলায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিকল্পনা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমিয়ে দেবে বলেও আশঙ্কা তার।
বৃহস্পতিবার ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চার লাখ ২২৬ কোটি টাকার এই বাজেটে ঘাটতি রয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এই ঘাটতি বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা এবং অভ্যন্তরীণ খাতে ব্যাংকঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে মেটানোর পরিকল্পনা করছেন অর্থমন্ত্রী।
যা গত অর্থ বছরের ঘোষিত বাজেটের (৩ লক্ষ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা) তুলনায় ১৭.৫২ শতাংশ বেশি এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় (৩ লক্ষ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা) ২৬.২০ শতাংশ বেশি। অর্থমন্ত্রী জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরেছেন ৭.৪ শতাংশ এবং সম্ভাব্য মুল্যস্ফীতি নির্ধারণ করেছেন ৫.৫ শতাংশ।
মুহিতের ঘোষণা করা বাজেটের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এফবিসিআই সভাপতি বলেন, ‘জাতীয় অর্থনীতির দুটি মূল উৎস রপ্তানি ও রেমিট্যান্স-এর প্রবৃদ্ধি বর্তমানে নিম্নমুখী। এছাড়াও সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষি ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা যা চলতি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার (২ লক্ষ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা) তুলনায় ১৮.৬৩ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রিত করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লক্ষ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা যা গত বছরের লক্ষ্যমাত্রা (২ লক্ষ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা) তুলনায় ২২.০৭ শতাংশ বেশি।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে শুধুমাত্র ভ্যাট খাতেই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা যা চলতি বছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা (৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি) তুলনায় ২৫.৪২ শতাংশ বেশি। এছাড়া আয়কর খাতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা যা চলতি বছরের (৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা) তুলনায় ১৮.৪০ শতাংশ বেশি। আমদানি শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ হাজার ২৩ কোটি টাকা যা চলতি বছরের (২২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা) তুলনায় ৩৩.৭৩ শতাংশ বেশি।
নতুন বাজেটে ঘাটতি দাড়াচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা যা জিডিপির ৫.৪%। চলতি অর্থ বছরের বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এফবিসিসিআই বলছে, ‘বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থা থেকে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা (ব্যাংক ব্যবস্থা ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা এবং জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা) নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের উপর নির্ভরশীলতা উৎপাদনশীল খাততে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’
নতুন ভ্যাট আইন নিয়েও উদ্বিগ্ন এফবিসিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। ভ্যাটের বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী মহল সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তায়নের পূর্বে আইনের কতিপয় বিষয় সংশোধনের জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু বাজেটে সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা এসবের প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করেছি। ’
ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে আবগারী শুল্ক বৃদ্ধি না করে পূর্ববর্তী অবস্থায় রাখার প্রস্তাব দিয়ে মহীউদ্দিন বলেন, ‘এতে আমানতকারী আমানত রাখতে নিরুৎসাহী হবে। এছাডা ব্যাংকিং চ্যানেলে না গিয়ে ইনফরমাল চ্যানেলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যা অর্থনীতির জন্য শুভ নয়।’
তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বাজেটে নির্ধারণ করা লক্ষ্যমাত্রা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া গতিশীল হবে বলেও আশা করছে এফবিসিসিআই। এসব অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি ব্যবস্থা কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে তারা।
শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘বাজেটে যে বড় প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে এটি অবশ্যই ভালো বাজেট। অংশিকভাবে বলা যায় এটা শিল্প ও ব্যবসা অনুকুল বাজেট।’
মন্ত্রী সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি করায় সরকারের প্রশংসা করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রভৃতি খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আওতায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা এবং মাসিক ভাতার হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেসাথে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বছরে দুটি উৎসব ভাতার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের মত আগামী বাজেটেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ’
মহিউদ্দিন বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নে অর্থায়ন ও অর্থ ব্যয় সঠিকভাবে করতে না পারায় প্রতিবছরই বাজেট সংশোধন করতে হয়। এতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উপর যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। বাজেট বাস্তবায়নে বছরের শুরু থেকেই সুষ্ঠু মনিটরিং জোরদার করা জরুরি। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং তদারকের মান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে।’
আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পরে
বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্তিগত জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘পরবর্তীতে বাজেট ডকুমেন্টস, অর্থ বিল পর্যালোচনা এবং এফবিসিসিআই-এর বাজেট এক্সপার্ট ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে আগামী ৩ জুন আমাদের প্রাথমিক মতামত তুলে ধরব। পরবর্তীতে বিশদ পর্যালোচনা এবং এফবিসিসিআই-এর সদস্যভুক্ত চেম্বার ও এসোসিয়েশনের মতামতের আলোকে এফবিসিসিআই-এর বিস্তারিত মতামত উপস্থাপন করা হবে।
