বিকৃত যৌনাচারই ছিল নেশা। ঘরে তার এগার নম্বর বউ। কাজের মেয়েও শয্যাসঙ্গী। পর্নো ছবি ছেড়ে স্ত্রী ও কাজের মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে চালাতো অনাচার।  লেডিস কসমেটিক্স দিয়ে নিজে সেজে থাকতো। ঠোঁটে লিপিস্টিক, চোখে কাজল মেখে সবসময় সাজগোজ করে থাকতো। সময়ের আলোচিত চরিত্র সালেহ আহম্মেদ ওরফে কার্লোস-এর প্রাথমিক বিবরণী এটা। কার্লোস উচ্চ শিক্ষিত। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। নিজেও কোটিপতি। মাদকাসক্ত। ঘরভর্তি নানা রঙের, নানা ডিজাইনের মেয়েদের অন্তর্বাস। খাওয়া-দাওয়ায়ও মুন্সিয়ানা। নানা আইটেমের সঙ্গে মুরগির মাংস আর ডাবের পানি থাকতেই হবে। খুব কম সময়ই বাইরে বের হতো কার্লোস। ঘরেই কাটাতো দিনের বেশির ভাগ সময়। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো সারাক্ষণ। ১০-১১ জন সাঙ্গপাঙ্গ। চরম এক বদমেজাজি এই কার্লোস। চুন থেকে পান খসলেই সংশ্লিষ্টদের ওপর চালাতো নির্যাতন। বৃহস্পতিবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে এসব কথা জানায়, কার্লোসের নির্যাতনের শিকার তার বাসার এক কাজের মেয়ে। গত ৩০শে জুনও কার্লোস নেশাগ্রস্ত হওয়ার এক পর্যায়ে কাজের মেয়ের ওপর নির্যাতন চালায়। হত্যা করতে পরীবাগের দিগন্ত টাওয়ারের নিজ বাসার সাত তলা থেকে ফেলে দেয়। বাসার অপর কাজের লোক ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা এবং তার স্ত্রীকেও বেধড়ক মারপিট করে। নির্যাতনে কাজের মেয়েটির ডান হাত-পা এবং কোমর ভেঙে গেছে। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গেয়ে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন কাজের মেয়েটি।
৩০ বছর বয়সী নির্যাতিত ওই নারী জানান, তিনি আগে গার্মেন্ট ও কয়েকটি বাসায় কাজ করেছেন। বছরখানেক আগে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে থাকতেন রিকশাচালক বাবার সংসারে। এই অবস্থায় নাজমা নামের এক মহিলা তাকে ওই বাসায় কাজ দেয়। নাজমা তাকে জানিয়েছিলো, প্রতিমাসে তাকে ১৫ হাজার টাকা দেয়া হবে। সে মোতাবেক গত মাসের ১৬ তারিখে তিনি কার্লোসের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দেন। ওইদিনই তার মোবাইলফোন কেড়ে নেয়া হয়। বাইরে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে নিষেধ করা হয়। বাসাটিতে সালেহ আহম্মেদ, তার স্ত্রী ও বৃদ্ধা এক কাজের বুয়া থাকতেন। দ্বিতীয় দিনই তাকে দিয়ে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ কাজ করায়। এসব দেখে ভয় পেয়ে কাজ ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাকে যেতে দেয়া হয়নি। উল্টো মারধর করে। এই গৃহকর্মী বলেন, কার্লোস সব সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে নেশা করতো। মেয়ে সেজে থাকতো। তার প্রসাধনরুম বিদেশি কসমেটিকস-এ ভর্তি। সেগুলো দিয়ে সাজগোজ করতো। মেয়েদের অন্তর্বাস পরে থাকতো। যে তাকে কাজে দিয়েছিলো সে কখনো এ বিষয়গুলো তাকে বলেনি। বলেন, তিনি ১৫ দিন ওই বাসায় কাজ করেছিলেন, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তাকে কখনো বাইরে বের হতে দেখেননি। যখন খাবার সময় হতো তখন দরজায় নক করতো। দরজা খুলে খাবার নিয়ে নিতো। ওই ঘরে প্রবেশ অন্য সবার জন্য নিষেধ ছিল। ডাক পড়লেই কেবল যেতে পারতো। তবে কোনো কোনো দিন ডাইনিংরুমে এসেও খাবার খেতো। যখন যেটা দরকার হতো, সেটা তার ড্রাইভারসহ আরো যারা আছে তাদের হুকুম করতো, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সামনে হাজির হয়ে যেতো। প্রতিদিন অন্তত ৫টি করে ডাব খেতো। গৃহকর্মী বলেন, যখন নেশা বেশি করতো তখন তার ডাক পড়তো। স্ত্রী ও তাকে দিয়ে একসঙ্গে মাস্টারবেশন করাতো। প্রথমদিকে এসব কাজে রাজি না হওয়ায় তাকে বেধড়ক মারধর করা হতো। হাতুড়ি পেটা করতো। তার স্ত্রী এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতো কিনা জানতে চাইলে নির্যাতিত এই গৃহকর্মী বলেন, তার প্রতিবাদ করার কোনো সাহসই ছিল না। সে নিজেও নির্যাতনের ভয়ে থাকতো। নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক আগেই তার পা ভেঙে গেছে। সে ছিল তার ১১ নং স্ত্রী। এছাড়া, প্রায় দিনই নতুন নতুন মেয়ে তার বাসায় আসতো। গৃহকর্মী বলেন, ঈদের পরদিন পাশের আরেকটি ভবনে বসবাসরত সালেহ আহম্মেদ কার্লোসের বাবার বাসায় তাকে কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় সে ওই পরিবারের লোকজনের কাছে তাকে ছেড়ে দেয়ার আকুতি জানায়। এ কথা শুনে ক্ষেপে যায় কার্লোস। তাকে বেধড়ক মারপিট করে বলে, ‘তোকে কিনে এনেছি, এখান থেকে বের হতে পারবি না।’ ঈদের পরদিন এই গৃহকর্মী তার ড্রাইভার সিদ্দিকের কাছেও আকুতি জানায়, সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য। পরে এ বিষয়টি জানতে পেরে তাকে আবারো মারপিঠ করে। সর্বশেষ ৩০শে জুনের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে গৃহকর্মী বলেন, ‘ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সে ঘরের বাইরে বের হয়ে খেতে চায়। কিন্তু খাওয়ার সময় ডাবের পানি না পেয়ে মারধর করতে থাকে। ওইদিন এতটাই ক্ষিপ্ত হয় যে, বৃদ্ধা কাজের বুয়া মনোয়ারা, তার স্ত্রী এবং তাকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে। হাতুড়ি দিয়ে পেটায়। ভয়ে স্ত্রী নিচে নামলে ড্রাইভারকে ফোন করে ধরে আনে। এরপর একটা রড বের করে আমার হাতে দিয়ে তার স্ত্রীকে পেটাতে বলে। কিন্তু আমি তা না করলে তার স্ত্রীর হাতে ওই রড দিয়ে আমাকে পেটাতে বলে। পরে সে নিজেই ওই রড দিয়ে পেটায়। এতে আমার হাত ভেঙে যায়। কোমরের হাড় ভেঙে যায়। তখন আমি চোখে-মুখে অন্ধকার দেখি। এর একপর্যায়ে চুল ধরে টেনে হেঁচড়ে আমাকে বেলকনি থেকে ফেলে দেয়। এরপর আর কিছু মনে নেই বলে তিনি জানান।’ পরে লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। তার স্ত্রীও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে তিনি সেখান থেকে অন্য একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
এ ঘটনায় ভিকটিমের মা বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। গত ১লা জুলাই বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ তার বাসা থেকে নির্যাতনে ব্যবহৃত হাতুড়ি উদ্ধার করে। এছাড়া পুলিশ ওই বাসা থেকে বেশকিছু গোপন তথ্য পায়। পরে বাসাটি তারা সিলগালা করে দেয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) জাফর আলী বিশ্বাস বলেন, একদিনের রিমান্ড শেষে ৪ঠা জুলাই তাকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে অভিযোগ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় কার্লোস। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে বৃদ্ধা গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগমও। এ ঘটনায় ব্যাপক গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে বলেও জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। এদিকে সারা শরীরে ক্ষত ও ভাঙা হাত-পা, কোমর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন এই গৃহকর্মী। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। মেয়েটি সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031