তুফান সরকার ক্ষমতার মোহে আরো অনেক নেতার মতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন বগুড়ায় ধর্ষণ-কা-ে গ্রেপ্তার শ্রমিক লীগের নেতা । স্থানীয় এ নেতা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, ধর্ষণের মতো অপকর্ম করেও ক্ষ্যান্ত হয়নি, ঘটনা প্রকাশ করায় ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে আবার ধর্ষণ। মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া ওই মেয়ে ও তার মায়ের।

কে এই তুফান সরকার
বগুড়ায় এক ভয়ংকর নাম তুফান সরকার। ক্ষমতার বলয়ে তাদের পরিবার বলে টু শব্দটি করার জো নেই তাদের বিরুদ্ধে। বড় ভাই বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন সরকার। স্ত্রীর বড় বোন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

তুফানের উত্থান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। বগুড়ায় জুয়ার আসর দিয়ে তার অবৈধ আয়ের যাত্রা শুরু। এরপর মাদক ব্যবসা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বগুড়ার মাদক রাজ্যের নিয়ন্ত্রক। আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুফান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য থাকলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি।

বড় ভাইয়ের সুবাদে রাজনীতিতে নাম লেখায় তুফান। একসময় তিনি শহর শ্রমিক লীগের সভাপতি হয়ে যান। এরপর শুরু হয় ব্যাটারিচালিত রিকশার লাইসেন্স ব্যবসা। ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা রাস্তায় নামানোর আগে প্রতিটির জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা নজরানা দিতে হয় তুফানকে। বগুড়া শহরে বর্তমানে ২০ হাজার ব্যাটরিচালিত রিকশা চলছে। এই হিসাবে মোট চাঁদা দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা।

এ ছাড়া প্রতিদিন এসব রিকশা থেকে ৩০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। এতে গড়ে প্রতিদিন ১০ হাজার রিকশা থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা তুফানের দরবারে চলে যায়। গরিব এসব রিকশাচালকের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে কোটিপতি বনে যান তুফান সরকার।

প্রকাশ্য এসব চাঁদা আদায় করলেও তুফানের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলার সাহস দেখায়নি। পুলিশ ও স্থানীয়  প্রশাসনও নিশ্চুপ তার নানা অপকর্মের বিষয়ে। ফলে বেপরোয়াভাবে নানা অন্যায়-অপকর্ম করে বেড়াচ্ছিল তুফান। তবে সাম্প্রতিক এক ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় আর পার পেলেন না তিনি। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নিয়েছে। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তুফানের আরো দিন সহযোগীকে।

তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ রবিবার দুপুরে ওই চারজনকে আদালতে হাজির করে তুফানসহ তিন আসামির সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্যাম সুন্দর রায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন তুফান সরকার, আলী আজম দিপু ও রুপম হোসেনের।

তুফানের আরেক সহযোগী আতিকুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ায় তার রিমান্ড চাওয়া হয়নি। জবানবন্দিতে ভর্তির কথা বলে ডেকে নিয়ে ওই কিশোরীকে তুফানের ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন আতিকুর।

অবশেষে দল থেকে বহিষ্কার তুফান   
সহযোগীদের দিয়ে তুলে নিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তুফানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগের নির্দেশের পর শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এই সিদ্ধান্ত নেয়।

রবিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সম্পাদকম-লীর বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বগুড়া ধর্ষণ নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বগুড়ায় একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। এটা আমাদের সহযোগী সংগঠন, তাই আমরা সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে তাদের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছি।’

আওয়ামী লীগের এই নির্দেশের পর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শ্রমিক লীগ থেকে তুফান সরকারকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি।

শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ বলেন, ‘আমরা তুফানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছি। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে।’

বগুড়া জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি শামছুদ্দিন শেখ হেলালও তুফানকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেলা দুইটার দিকে জরুরি সভায় বসা হয়। সভা থেকে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকারকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তাকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি

বগুড়ার আলোচিত এই ধর্ষণ ঘটনার বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত বের করতে বগুড়া জেলা প্রশাসক নূরে আলম সিদ্দিকী তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সামাকে প্রধান করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, ওই কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিস্তারিত জানানোর জন্য বলা হয়েছে।

কী হবে সেই মেয়েটির?

সবে এসএসসি পাস করা মেয়েটির স্বপ্ন ছিল ভালো একটি কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু ডিজিটাল ভর্তির ফাঁদে আটকে যায় তার স্বপ্নের পথচলা। কোনো কলেজেই আসন জোটে না তার ভাগ্যে। এই সুযোগে প্রতিবেশী আলী আজম দিপু তাকে শ্রমিক লীগের নেতা তুফান সরকারের মাধ্যমে সরকারি কলেজে ভর্তি করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। তুফান সরকারের অনেক ক্ষমতা জেনে কিছুটা বিশ্বাস জন্মেছিল ওই কিশোরী মনে। কিন্তু তার জন্য যে এক বীভৎস হায়েনা অপেক্ষা করছিল ঘুনাক্ষরে ভাবেনি সে। ভর্তি তো দূরের কথা তুফানের হাতে ধর্ষণ আর নির্যাতনের  শিকার হতে হলো তাকে।

মেয়েটির বাবা গ্রামীণ বাজারে সামান্য পুঁজির ব্যবসা করেন। আর মা ঢাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। এত দিন মেয়েটি নানির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। কিছুদিন আগে মা বগুড়ায় ফিরে গেলে সে তার মা-বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করে।

রোববার দুপুরে হাসপাতালে তার সঙ্গে কথা বললে সে ওই দিনের লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করে। তার ভাষ্য, ‘আমাদের বাসায় তো তালা দিছিল আশা আপু (তুফানের স্ত্রী), আমার বাসায়, নানুর বাসায়, মামার বাসায়। ঢাকায় থেকে শুনলাম। তারপর রুমকি মামি (মহিলা কাউন্সিলর) আমাদের বলতেছে, ‘তোদের মারলে আমার কিচ্ছু হবে না। আমি তিনটা ওয়ার্ডের কমিশনার, পুলিশকে টাকা খাওয়ালেই শেষ, তোরা কী ভাবতেছিস’। আবার আশা আপু আমাকে ফোন করে বলে, এসিড মারবে। অনেক ম্যাসেজ লিখছে জঘন্য ভাষায়, আছে এখনো ম্যাসেজগুলো। সে আরো বলে, ‘সবাই বলল, আস, রুমকি একটা বিচার করবেনি’। তাদের কথায় আমরা সরাসরি ঢাকা থেকে গিয়ে রুমকি মামির বাসায় উঠলাম। তারা বলতিছে, ‘আশা আসুক। তারপর বিচার হবে।’ আশা আপু গু-া-পা-াদের নিয়ে আসল। তারপর অনেক মারধর করল। আশা আপুর মা, রুমকি মামি অনেক মারধর করছে।  ওদের বাসার কাজের ছেলে মুন্না আমার বেনিটা আগে কেটে দিল। তারপর আমার চুল ছোট ছোট করে কেটে দিল। পরে নাপিতকে ডেকে এনে একদম নাড়ু (ন্যাড়া) করে দিল। আমাকে করছে, আমার মাকেও একদম নাড়ু করে দিছে!’

মেয়েটির মায়ের সঙ্গে কথা বললে তিনিও জানালেন তুফান পরিবারের হাতে নির্যাতনের কথা। ধর্ষণের ঘটনার বিচার করে দেয়ার কথা বলে ধর্ষিতা ও তার মাকে পৌর কাউন্সিলর রুমকী তার অফিস চকসুত্রাপুরে নিয়ে যান। সেখানে বিচারের নামে ধর্ষিতাকে পতিতা আখ্যায়িত করে এবং মেয়েকে দিয়ে দেহব্যবসা করানোর অভিযোগ আনা হয় মায়ের বিরুদ্ধে। এরপর তুফান সরকারের কয়েকজন সহযোগী স্টিলের পাইপ দিয়ে মা ও মেয়েকে পিটিয়ে আহত করে। ওই দিন তাদের টানা চার ঘণ্টা ঘরের ভেতর আটকে রেখে দফায় দফায় তাদের পেটায়। পরে নাপিত ডেকে মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। এরপর ২০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে রিকশায় তুলে দেয়া হয় মা-মেয়েকে।

ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, গত ১৭ জুলাই শহর শ্রমিক লীগের সভাপতি তুফান সরকার কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বলে ওই কিশোরীকে বাসায় ডেকে নেয়। এরপর দিনভর তাকে আটকে রেখে কয়েক দফা ধর্ষণ করে। এতে ওই কিশোরী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটি ওই কিশোরীর মা জানতে পারে এবং বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে তুফান সরকারের স্ত্রীর কানে যায়।

এরপর শুক্রবার বিকেলে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন তার বড় বোন পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের  নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকি এবং তার মা রুমী বেগম ওই ধর্ষিতা ও তার মায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরে তাদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয় তারা।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031