মার্জিয়া হাসান রুমকি অতি সাধারণ এক নারী । এই অতি সাধারণই ক্ষমতার কাছে হয়ে ওঠেন অতি অমানবিক। ক্ষমতা তার থেকে কেড়ে নেয় প্রেম-ভালোবাসা। এটাই প্রমাণ করে ধর্ষণের শিকার হওয়া কিশোরী এবং তার মায়ের উপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায়। মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও রুমকি এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। যা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আর একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ায় দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ক্রমান্বয়ে আরো ক্ষমতাধর হতে থাকে। হিংস্রতা আর অবৈধ কাজে নিজেকে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে।
আর পাশাপাশি নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকিকে আর পায় কে? শহরের চকসুত্রাপুর এলাকার জাহিদ হাসানের স্ত্রী এই রুমকি। তার মা রুমি বেগম। পিতা শহরের বাদুড়তলা এলাকার জামিলুর রহমান রুনু। বগুড়া পৌরসভার ৪, ৫, ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কয়েক দিনের মাথায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ছোট বোন আশার স্বামী তুফান সরকার ও তার বড় ভাই মতিন সরকার বগুড়ার বিশেষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অন্যতম। মতিন সরকার বর্তমানে জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আর শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সেই সুবাদে নির্বাচনে প্রভাব খাটিয়ে জেতার অভিযোগ প্রতিপক্ষের। কাছের আত্মীয়রা ব্যাপক ক্ষমতাধর হওয়ায় সেও এক সময় হয়ে ওঠে ক্ষমতার মালিক। কাউন্সিলর হওয়ার আগে থেকেই বোন জামাইয়ের মাদক ব্যবসার আদি অন্ত তার নখদর্পণে ছিল। কাউন্সিলর হওয়ার পরেই বগুড়ার মাদক রাজ্যের রানি বনে যান তিনি। নির্বিঘ্নে চলতে থাকে তাদের পারিবারিক মাদক ব্যবসা। পুলিশ প্রশাসনের কাছে তাদের পুরো তথ্য থাকলেও দল ক্ষমতায় থাকার কারণে এতদিনে কেউ কিছু বলেনি।
শহরের বাদুড়তলায় মাদকে সয়লাভ: বগুড়া শহরের বাদুড়তলা এলাকায় এখনো কেউ রাত ৯টার পর বিশেষ কাজ ছাড়া যেতে চায় না। প্রতিনিয়তই এখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এই এলাকায় শতাধিক ছিনতাইকারী, পকেটমারের বাস। মাদক বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে তারা রাত হলে ছিনতাইয়ে নামে। এসব ছিনতাইকারী, মাদক বিক্রেতারা ওই নারী কাউন্সিলরের ছত্রছায়ায় অপকর্ম থাকে। এমন অভিযোগ স্থানীয় সাধারণ বাসিন্দাদের থাকলেও কখনো এদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। মাঝে মাঝে পুলিশ কিছু ছিনতাইকারী, মাদক বিক্রেতাকে আটক করলেও তাদের নির্মূল করতে পারেনি।
তুফান কর্তৃক কিশোরী ওই মেয়েকে ধর্ষণ ঘটনায় পুলিশের শক্ত ভূমিকায় সাধারণ মানুষ আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করেছে। এতে বেরিয়ে আসছে ওই নারী কাউন্সিলরের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি।
রুমকির ছোট বোন আশা। তার স্বামী তুফান সরকার। বড় ভাই মতিন সরকার। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই দুই সরকার হয়ে উঠে বগুড়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এই দুই ক্ষমতাধরকে কাছে পেয়ে রুমকিও রাতারাতি পেয়ে যায় ক্ষমতার সিঁড়ি। শহরের বাদুড়তলা, চকসূত্রাপুর, নামাজগড় এলাকার হিরোইন হয়ে উঠে সে।
মতিন সরকার গোটা উত্তরাঞ্চলের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন। অবৈধ মাদক ব্যবসার অভিযোগে তিনি অনেক বার পুলিশের হাতে আটক হন। তিনি র্যাবের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। একটি মামলায় তাঁর ২৭ বছরের সাজা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে তা এখন স্থগিত আছে। পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং রেলের জায়গা দখলের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। অল্প সময়ে তিনিও হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান।
বগুড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন না। তাঁরা শহরে চলাফেরা করেন দলবল নিয়ে। বগুড়া শহরের সব মাদকের ঘাঁটি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। এর সঙ্গে আছে দখল আর চাঁদাবাজি।
জানাযায়, বগুড়া শহরে বেশ কয়েকটি মাদকের স্পট আছে। সেউজগাড়ী, মালতিনগড়, জলেশ্বরীতলা, চেলোপাড়া, তিনমাথা, চারমাথা, জরুহুল নগর, পুরান বগুড়া এলাকা মাদকের জন্য বিখ্যাত। এসব এলাকায় যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা সবাই এই দুই ভাইয়ের নিয়োগকৃত। বাদুড়তলা, চকসূত্রাপুর এবং নামাজগড় এলাকার মাদকের সার্বিক দেখাশোনা রুমকির হাতে। পুলিশ জানলেও এতদিন তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালায়নি।
বগুড়া জেলা বাসদের আহ্বায়ক অ্যাড: সাইফুল ইসলাম পল্টু বলেন, বগুড়া শহরের পুরো মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন রুমকি এবং তার পরিবারের লোকজন। এতদিন তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পায়নি।
বগুড়ার মানুষ সরকার পবিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তিনি তাদের হাত থেকে বগুড়াবাসীকে মুক্তি দেয়ার জন্য দাবি জানান। তিনি আরো বলেন, নারী কাউন্সিলর রুমকি নারী হয়ে অন্য আরেকটি নারীকে যেভাবে নির্যাতন করেছে তাতে সে পুরো নারী সমাজকে কলুষিত করেছে। তিনি বগুড়ার আলোচিত এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন।
যেভাবে ফেঁসে গেলেন রুমকি: গত ১৭ই জুলাই শহর শ্রমিকলীগের সভাপতি তুফান সরকার কলেজে ভর্তি করে দেয়ার কথা বলে ওই কিশোরীকে বাসায় ডেকে নেয়। এরপর দিনভর তাকে আটকে রেখে কয়েক দফা ধর্ষণ করে। এতে ওই কিশোরী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হয়। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটি ওই কিশোরীর মা জানতে পারে এবং বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে তুফান সরকারের স্ত্রীর কানে যায়। এরপর শুক্রবার বিকালে তুফান সরকারের স্ত্রী আশা খাতুন তার বড় বোন পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকি এবং তার মা রুমী বেগম ওই ধর্ষিতা এবং তার মায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। পরে তাদের দুই জনের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। এই ঘটনা প্রথমে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মাঝে জানাজানি হলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহরব্যাপি। এরপর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে খবর পৌঁছলে ঘটনার নায়ক তুফানসহ তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিন রাতে পাবনা থেকে আটক করা হয় রুমকিকে। রুমকি বর্তমানে ৪দিনের পুলিশ রিমান্ডে আছে। রুমকিসহ রিমান্ডে আসামিরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। অপর দিকে তুফানও ওই কিশোরীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে তাদের সহযোগী সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে দলটি কেন্দ্রীয় ভাবে একটি তদন্ত টিম বগুড়ায় পাঠাবে। কবে নাগাদ পাঠাবে সে বিশষে এখনো চূড়ান্ত কিছু জানা যায়নি।
এদিকে জেলা বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাধীন মা-মেয়ের খোঁজ খবর নিয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপস্থিতি ছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস, অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা পপন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শাহ মেহেদী হাসান হিমু, শহর যুবদলের সভাপতি মাসুদ রানা, শ্রমিকদল নেতা লিটন শেখ বাঘা প্রমুখ। জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদেরকে জানান, বিএনপি সব সময় নির্যাতিতদের পাশে আছে এবং থাকবে। তিনি বলেন বর্বরোচিত এই নির্যাতন সভ্য সমাজে মেনে নেয়া যায় না। তিনি সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ ঘটনার প্রতিবাদ করার আহ্বান জানান।
এদিকে গ্রেপ্তারকৃতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে এখনও সোচ্চার রয়েছে বিভিন্ন সংগঠন সোমবার শহরে মানববন্ধন করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো। পাশাপাশি জেলা যুবলীগ এক বিবৃতিতে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।
ফুঁসে উঠেছে বগুড়ায় মানুষ: বগুড়ায় কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সাধারণ মানুষ। ধর্ষক এবং তার সহযোগীদের বিচারের দাবিতে গতকালও বিভিন্ন সামাজিক সাংকৃতিক সংগঠন শহরের বিক্ষোভ, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। এদিকে পুলিশ ওই মামলার এজাহারভুক্ত ১০ আসামির মধ্যে ৯জন এবং সন্ধিগ্ধ আরো ২ জনসহ ১১জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়া শহরের সাতমাথায় বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, সিপিবি-বাসদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বগুড়া জেলা সংসদ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফোরাম।
অপরদিকে শহরের নবাববাড়ী রোডে জেলা বিএনপি ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে বক্তারা ধর্ষণ ঘনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল আকাল আজাদ জানান, তুফানসহ ৩ জনের রিমান্ড মঙ্গলবার শেষ হচ্ছে। আজ বুধবার তাদের আদালতে হাজির করা হবে। অপরদিকে ধর্ষণের শিকার কিশোরী এবং তার মাকে আদালতে হাজির করে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, নারী শিশু আদালত-১ এর পিপি আমানুল্লাহ ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরী এবং তার মাকে সেফ হোমে রাখার আবেদন করেছেন আদালতে। আদালত আগামীকাল সেই আবেদনের শুনানি দিতে পারে।
| M | T | W | T | F | S | S |
|---|---|---|---|---|---|---|
| 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 |
| 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 |
| 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 |
| 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 |
| 29 | 30 | 31 | ||||
