মুহূর্তেই একজন রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে উঠতো অস্পৃশ্য।  একসময় পত্রিকার পাতা খুলতেই এসিড সন্ত্রাসের খবর দেখতে পেতাম। রাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ বেছে নিয়েছিলো এই নোংরা পথ। দেশে এসিড সহজলভ্য ছিলো, তাই যেখানে সেখানে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ, বলা ভালো নারী ও শিশু। পুরুষ এসিডের শিকার হয়েছেন কি না বলতে পারছি না। তবে একজন নারীকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেয়ার এই প্রয়াস ভীষণ কার্যকরী।

ক্যাম্পাসেও দেখেছি, যে মেয়ের প্রেমে কেউ হাবুডুবু খেত, যার সম্পর্কে একটা কটু কথাও সে শুনতে পারত না, প্রেম নিবেদনে সাড়া না পেয়ে সেই নারীই হয়ে উঠতো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম নারী। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এমনকি সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েও এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন নারী। এক সময় এই বীভৎসতা মহামারিতে রুপ নিলে সরকার আইন করে এর কঠোর শাস্তির বিধান করে। আর ব্যাটারি থেকে যত্রতত্র এসিড পাওয়া যেত বলে ব্যাটারি পরিবর্তনের সময় পুরনো ব্যাটারি জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয় তখ থেকেই। সেই সাথে পুরনো ব্যাটারির একটা মূল্যও নির্ধারণ করে দেয় সরকার, এতে উৎসাহ দেয়া যেন মানুষ পুরনো ব্যাটারি ফিরিয়ে দেয়। মূলত কঠোর আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করায় ও তা দ্রুত বিচারের আওতায় আনায়, সেই নিষ্টুরতা কিছুটা হলেও কমেছে। এখন খুব বেশি শোনা যায় না।

ভারতের নয়াদিল্লিতে একটি চলন্ত বাসে একজন ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ভারতসহ বিশ্ব সোচ্চার হয়ে উঠলেও বাঁচানো যায়নি কন্যা সাহসীকাকে। ভারতে এখনও এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, যদিও সেই ঘটনায় কঠিন সাজা হলেও পার পেয়ে গিয়েছিলো একজন কিশোর অপরাধী, যে ছিলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর।

ভারতে সেই আলোচিত ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালে। বাংলাদেশেও এই ধরনের নোংরা একটা ঘটনা ঘটেছিলো ২০১৩ সালের শুরুর দিকে। মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার পথে। বাসের ড্রাইভার ও হেলপার মিলে ঘটিয়েছিলো সেই কাণ্ড। কিছুদিন আগে দেখলাম নারায়ণগঞ্জে একটি কিশোরীরে (মেয়েটি রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলো) পিকআপ চালক তার সহযোগীকে নিয়ে ঘটিয়েছে সেই একই কাণ্ড। তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পত্রিকায় পড়েছি।

বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে দুই ছাত্রী লাঞ্ছিত হয়েছেন আর তাই নিয়ে আপন জুয়েলার্স এর শত শত কেজি স্বর্ণ জব্দ করা নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। এর পর বনানীতে আবারো, যাত্রাবাড়ীতে, বগুড়াতে তুফান কাণ্ড গোটা দেশ কাঁপিয়ে দিলেও থেমে নেই ধর্ষণ। এইতো কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে দিনের পর দিন একটি তরুণীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। আসামি একজন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার প্রভাব এখানে কাজ করছে।

বরগুনার বেতাগী উপজেলায় একজন স্কুল শিক্ষিকাকে শ্রেণিকক্ষে আটকে রেখে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই দেশে ২২ মাসের শিশুকেও ধর্ষণ করা হয়। চাঁদা না পেয়ে স্বামীকে বেঁধে রেখে নির্লজ্জ ধর্ষণের খবর আমরা এখন অবলীলায় পত্রিকায় পড়ছি! এমনই শত শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলছে দেশে।

বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণী পুরান ঢাকায় খালু কর্তৃক ক্রমাগত ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভ ধারণ করায় তা প্রকাশ্যে আসে। এই কিছুদিন আগে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় পৌনে চার বছরের তানহাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে তারই প্রতিবেশী। মেয়েটিকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। চকলেটের লোভ শিশুদের থাকতেই পারে, তাই বলে এই বিশ্বাসটুকু একটা শিশু যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে এই সমাজের গন্তব্য কোথায়? কয়েকজন কুলাঙ্গারের কাছেই কি তবে জিম্মি হয়ে থাকবে গোটা মানব সভ্যতা?

বাংলাদেশে প্রতিদিন আগুণতি মামলা হয় নারী নির্যাতনের, যার সিংহভাগ আবার ধর্ষণজনিত। কিন্তু প্রায় অধিকাংশ মামলাই শেষ পরিণতি পায় না। বলা হয় এসবের অধিকাংশ মামলা হয় কাউকে না কাউকে বিশেষ করে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য? এ কেমন হাতিয়ার?

তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তেন, দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত আবাসনেও তিনি নিরাপত্তা পাননি। হত্যা করা হয়েছিল তাকে, প্রথম ময়নাতদন্তে আলামত না পেলেও দ্বিতীয় দফার ময়নাতদন্তে ধর্ষণের আলামত মিললেও অপরাধীর খোঁজ মেলেনি আজও। মডেল তিন্নির লাশ পাওয়া গিয়েছিলো ব্রিজের পিলারে, কেউ তাকে ধর্ষণ করে ফেলে দিয়েছিল। তিন্নি হত্যার পর একজন সাবেক সংসদ সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কিন্তু বিচার হয়নি আজো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মানিক কেলেঙ্কারি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকেই। সেই মানিক সেঞ্চুরি করেও অপরাজিত থেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকরি হারাচ্ছেন একের পর শিক্ষক… কোথায় যাচ্ছি আমরা?

অবাধ যৌনাচারের Promiscuity যুগ অতিক্রম করেও আমরা বন্য জানোয়ারের মতো হামলে পড়ছি কেন? পত্রিকার পাতায় পাতায় ধর্ষণের মহামারিতে অতীষ্ঠ আমরা। আইনের কোন না কোন ফাঁক ফোঁকর নিশ্চয়ই আছে, তা না হলে বনানীর রেইন্ট্রি হোটেলের ঘটনায় একের পর এক দিন তারিখ নিয়ে কালক্ষেপণের অর্থ কি? এই দায় কার? নিশ্চিত ভাবেই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার দিতে বাধ্য।

কেন বাড়ছে ধর্ষণ? আমার মনে হয় এর জন্য কতিপয় কারণ চিহ্নিত করা আবশ্যক। যেমন:

আইনের মারপ্যাঁচ ও বিচারে বিলম্ব: আদালতে শুনেছি এমন শব প্রশ্ন নির্যাতিতাকে করা হয়, যা দ্বিতীয়বার শোনার রুচি তিনি হারিয়ে ফেলেন। বারবার সময় চেয়ে হয়রানি করা হয় আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই।

রাজনৈতিক ছত্রছায়া: ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা নিজেদের যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে তখন এই ধরনের অপকর্মে নিজেরাই জড়িয়ে পরে। এর প্রমাণ বাংলাদেশে অসংখ।

পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব: পরিবার থেকেই শিক্ষার সূত্রপাত। নীতি ও নৈতিকতাবোধ এখান থেকেই পেয়ে থাকে মানব শিশু। ব্যস্ততা ও পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার এই যুগে ক্রমেই বিগড়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। ধর্মীয় শিক্ষা এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপে সক্ষম।

মাদক: মাদক এখন অনেক সহজলভ্য আর নিত্য নতুন মাদকে আসক্ত হয়ে তরুণদের মধ্যে বিপথগামীতা বেড়েই চলছে।

তারুণ্যের উদ্দাম: তরুণেরা সাধারণত বাঁধনে আবদ্ধ না হয়ে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। এদ্দামতায় অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিগৃহীত হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ থ্রিল ভাবছেন।

মুক্ত সংস্কৃতির প্রভাব: তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সংস্কৃতি এখন উন্মুক্ত। অযাচিত ও অস্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে তৈরি সিরিয়াল, ছবি ও গল্পে কেউ প্রভাবিত হয়ে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।

অনলাইনের সম্পর্ক: আমরা অনেকেই অপরিচিত হয়েও খুব কাছে চলে আসছি অনলাইনের যুগে। এই সুযোগে ধর্ম, চিকিৎসা, পরামর্শের নামেও নারীদের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এর বাইরেও আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। মোটাদাগে এই কারণগুলোই এখন মনে হচ্ছে এই মহামারির জন্য দায়ী। এর জন্য শুধু রাষ্ট্র নয়, প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সুশীল সমাজকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

দ্রুত বিচার মানে দ্রুততম সময়েই এই সব মামলা পরিচালনা করা হোক। প্রয়োজনে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন আইনজীবীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী প্যানেল করে এই সব মামলা পরিচালনা ও মামলার কার্যক্রম কঠোর ভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ধর্ষণের এই মহামারির বন্ধ না হলে সমাজিক বিপর্যয় আসন্ন।

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকারকর্মী

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031