পিচের মাঝখানে দাঁড়িয়েই দুই হাত উপরে তুলে জোরালো আবেদন করলেন লেগ বিফোর উইকেটের। আগের বলেও জোরালো আবেদন করেছিলেন তাইজুল। কিন্তু বলের উচ্চতা বেশি থাকায় আম্পায়ার তাতে সাড়া দেননি। তাইজুলের পরের বলটি অনেক নিচু হয়ে ফের আঘাত হানলো হ্যাজেলউডের পায়ে। এবার আর আঙুল না তুলে পারলেন না ইংলিশ আম্পায়ার নাইজেল লং। তাইজুল অপার অসীম আনন্দে জায়গাতে দাঁড়িয়েই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে উল্লাস করতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো গোটা বাংলাদেশও। সাকিব আল হাসানই প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাইজুলের ওপর। এরপর খেলোয়াড়দের একে অপরকে জড়িয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করতে থাকেন। পার্শ্বরেখার বাইরে অপেক্ষায় থাকা অতিরিক্ত খেলোয়াড় ও কোচেরাও ততক্ষণে মাঠের ভেতরে ঢুকে কোলাকুলি অভিনন্দন বিনিময় করতে থাকেন। জয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশ দলকে উৎসাহ যোগাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাত্রই মাঠে আসন নিয়েছেন। এক ওভার না যেতেই জয় নিশ্চিত করে মুশফিক বাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ছেলেকে নিয়ে মাঠে ঢোকেন ৭০তম ওভারে। আর জয় নিশ্চিত হয় ৭০.৫ ওভারে। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানান। কেউ একজন পেছন থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে বাংলাদেশের বিশাল এক পতাকা তুলে দিলেন। তিনি তা হাতে নিয়ে নাড়াতেও থাকলেন। এক অপার্থিব আনন্দ তখন শেখ হাসিনার চোখেমুখে। পাশের আসনেই বসা ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান। বিশেষ অতিথিদের বসার (ভিভিআইপি গ্যালারি) ওই অংশের সবাই তখন দাঁড়িয়ে যে যার মতো আনন্দ-উল্লাস করছিলেন। বাঁধহারা আনন্দ বলতে যা বোঝায়। ফোনে প্রিয়জনকে ঐতিহাসিক এ আনন্দ সংবাদও দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। আরেকটি ইতিহাসের সাক্ষী যে হলেন সবাই। বন্যাদুর্গত মানুষের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফুটিয়েছে এ জয়। আর ঈদুল আজহার তিনদিন আগে পাওয়া এ জয় দেশবাসীর জন্য ক্রিকেটারদের স্মরণীয় এক উপহার হয়ে রইলো। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি শুরু হবে ঈদের একদিন পরেই। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টটি মাঠে গড়াবে ৪ঠা সেপ্টেম্বর।
জয়টা মাত্র ২০ রানের তবে অনেক বড় এক মাইলফলক স্পর্শ হলো এতে। ১০১তম টেস্টে বাংলাদেশ পেলো ১০ম জয়। আর টেস্ট খেলুড়ে পঞ্চম কোনো দেশের বিপক্ষে জয় এটি। প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে হারালো বাংলাদেশ। এ জয়ে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিংয়ে তেমন উন্নতি না হলেও অস্ট্রেলিয়ার অবনমন নিশ্চিত হয়ে গেছে। ৪ থেকে ৫এ নেমে গেছে তারা। পরের টেস্টে হারলে তারা নামবে ৬এ। টেস্ট র্যাঙ্কিং শুরু হওয়ার থেকে এই প্রথম চার নম্বরের নিচে নামলো অস্ট্রেলিয়া, যারা সবচেয়ে বেশি সময় ছিল এক নম্বরে।
গত এক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকেই বলা যায় উত্থানের শুরু। প্রথমে ওয়ানডে ক্রিকেট এরপরে টেস্ট ক্রিকেটেও সামর্থ্যের স্বাক্ষর রেখে সমীহ আদায় করছে বাংলাদেশ দল। ২০১৬-এর আগে বাংলাদেশ দলের জয় বলতে ছিল জিম্বাবুয়ে আর দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। আর গত অক্টোবর থেকে টেস্টেও নতুন বাংলাদেশ। প্রথমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিপক্ষে জিততে জিততে ২২ রানে হার। এরপরেই ১০৮ রানের জয়। অবশ্য তারও আগে নিউজিল্যান্ডের মাটিতেই বাংলাদেশ উন্নতির প্রমাণ দিয়ে আসে। জিততে না পারলেও সমীহ আদায় করেছিল তারা ঠিকই। আর এ বছর সিংহল দ্বীপে পড়ে বাঘের থাবা। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে আরো এক ইতিহাস গড়ে মুুশফিক বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় হার মানলো অজিরাও।
নিন্দুকেরা বলছে, যে ভয়ে বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইছিল না অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল সে ভয়ই বাস্তবে পরিণত হলো। ২০০৬ সালের পর বাংলাদেশের বিপক্ষে এবারই প্রথম টেস্টে মুখোমুখি হলো অজিরা। ২০১৫তে আসার কথা থাকলেও নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সফর বাতিল করে তারা। এর আগে মাত্রই চারবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া। ২০০৩এ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে যখন খেলতে যায় বাংলাদেশ তখন টেস্ট ক্রিকেটে তখন তাদের হামাগুড়ি দেয়ার বয়স। ২০০৬এ বাংলাদেশের মাটিতে এসে বাঘের হুমকি পায় ক্যাঙ্গারুর দল। ফতুল্লায় প্রায় হারতে বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। কোনোমতে বেঁচে যায় সে দফায়। এবার আর রক্ষা হলো না।
টেস্ট শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাস দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। সিরিজ শুরুর আগে প্রতিদিনই দুই দলের একজন করে খেলোয়াড় সংবাদ মাধ্যমের সামনে কথা বলেছেন। তাতে বাংলাদেশ দলের সবাই বলছিলেন ২-০তে হারানো সম্ভব। মুশফিক বলেছিলেন, আমরা এসব বলার জন্য বলছি না, জেতার সামর্থ্যও আছে আমাদের। গতকাল অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক আরো একবার বিস্মিত হলেন। সত্যিই তো অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ! বললেন, দারুণ খেলেছে তারা। এ হারের কোনো অজুহাত নেই। স্বীকার করলেন ব্যাটে-বলের লড়াইয়ে হেরে গেছেন তারা।
বাংলাদেশ এখন আর ড্র করার জন্য নামে না এমন কথা হরহামেশাই বলছেন ক্রিকেটাররা। শুরু থেকে মাথায় জয়ের চিন্তাই থাকে। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে রকেট অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ সিরিজ শুরুর দিন থেকেই তার ছাপ স্পষ্ট। টসে জেতার পর অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের শক্তি ও সাহস যেন বেড়ে যায় আরো। প্রতিটি খেলোয়াড়ের শরীরী ভাষায় লড়াইয়ের চেতনা ফুটে উঠছিল। তামিম আর সাকিব তাদের ৫০তম টেস্টটিকে স্মরণীয় করে রাখার প্রত্যয়েই নেমেছিলেন। দুজনই তাদের সামর্থ্যের প্রদর্শনী দিলেন দারুণভাবে। এর চেয়ে ভালো নৈপুণ্য আর হতে পারে না। একজনের দুই ইনিংসেই ফিফটি। আরেকজনের দুই ইনিংসেই পাঁচ উইকেট। সাকিব এগিয়ে গেছেন তার ৮৪ রানের ইনিংসে। অস্ট্রেলিয়ার মাত্র ডেভিড ওয়ার্নার ফিফটি প্লাস ইনিংস খেলেন যা ১১২তে থামে। তারই এই ১৯তম টেস্ট শতকটি কোনো উপকারেই আসেনি দলের। হারের ব্যবধানটা কমিয়েছে কেবল। দেশের বাইরে এটি তার পঞ্চম শতক। ওয়ার্নার আর স্মিথ যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন ততক্ষণ বাংলাদেশের সবার মধ্যেই একরকম সংশয় কাজ করছিল। কিন্তু সাকিবের বলে লেগ বিফোর উইকেট আউট হওয়ার পরেই ভাঙে ১৪০ রানের জুটি। অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ তখন ১৫৮। ৯৯ বলে ৩৭ রান করে স্মিথও সাজঘরে ফেরেন সাকিবের বলে। এরপর অজিদের প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ পাননি কেউ। স্পিনার তাইজুল দারুণ বল করে সাহচর্য দেন সাকিবকে। সাকিব ৫ উইকেট নেন ৮৫ রানে। আর তাইজুল ৩ উইকেট নেন ৬০ রানে। মেহেদী হাসান মিরাজ ২ উইকেট নেন ৮০ রানে। ১০টি উইকেটই নেন স্পিনাররা। আগের ইনিংসেও ৯ উইকেট নেন তারা। সাকিব টেস্টে ১০ উইকেট আর ৫০এর বেশি রান করলেন দ্বিতীয়বার। এরচেয়ে বেশি তিনবার এ কৃতিত্ব দেখান কেবল একজনই নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি। ম্যাচসেরার পুরস্কারটিও ওঠে তার হাতে।
দলের হার এড়ানোর লড়াইয়ে চোটের কারণে সিরিজ শেষ নিশ্চিত হওয়ার পরেও হ্যাজেলউডকে মাঠে নামতে হয়। ১০ বল খেলে তিনি কোনো রান করতে না পারলেও দশম উইকেট জুটিতে কামিন্সের সঙ্গে ১৬ রানের অংশীদার হন তিনি। কামিন্স অবশ্য ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন মিরাজের এক ওভারে দুই ছক্কা হাঁকিয়ে। ৫৫ বলে ৩৩ রান করে অপরাজিত থাকেন তিনি। হ্যাজেলউডের বিদায়ে সাড়ে তিনদিনের কম সময়ে সমাপ্তি ঘটে টান টান উত্তেজনার এক টেস্ট। ২৪৪ রানে থামে অজিদের দ্বিতীয় ইনিংস। প্রথম ইনিংসে তারা করেছিল ২১৭ রান। আর বাংলাদেশ ২৬০ রানের পর করেছিল ২২১ রান।
টেস্ট ক্রিকেট যে তার আবেদন হারায়নি এখনো তার উদাহরণ হতে পারে এ টেস্টটি। আগের দিনই আরেক সেরা দল ইংল্যান্ডকে অবিশ্বাস্যভাবে হারিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ইংল্যান্ডের মাটিতে এরপরেই অ্যাশেজ খেলার জন্য যাবে অস্ট্রেলিয়া দল।
