বিএনপি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরকে সফল ও অর্থবহ বিবেচনা করছে । এ সফরে নানামুখী সাফল্যের প্রকাশ দেখছেন নেতারা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে দলীয় স্বার্থ নয়, মানবতা ও বাংলাদেশের  জাতীয় স্বার্থ দুটোকেই প্রধান করে দেখেছে বিএনপি। মানবতাকে প্রধান্য দিতেই সফরে কোনো পথসভা বা রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি খালেদা জিয়া। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি যে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন তা এ ইস্যুতে সরকারের সহায়ক হবে। সরকার সেটাকে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের ঘাড় থেকে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত অবসান ঘটবে।

 অন্যদিকে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও প্রশাসনের নানামুখী প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ঢাকা থেকে উখিয়া দীর্ঘ ৪৭৫ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি তা বিএনপি চেয়ারপারসন ও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের করেছে অনুপ্রাণিত। দেশের সুশাসন ও সুদিনের প্রত্যাশী সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটাবে। খালেদা জিয়ার এ সফরে সাধারণ মানুষ সরকারকেও একটি বার্তা দিয়েছে। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে খালেদা জিয়াকে অভিবাদন জানানোর মাধ্যমে সরকারের প্রতি জানিয়েছে নীরব প্রতিবাদ। বিএনপির তরফে খালেদা জিয়ার উখিয়া সফরকে রাজনীতির রঙ্গে রাঙানোর প্রত্যক্ষ উদ্যোগ না থাকলেও পরোক্ষভাবে এটা পরিণত হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণার উপলক্ষ। প্রশাসনের কড়াকড়ি ও ক্ষমতাসীনদের প্রতিবন্ধকতায় রাজপথের রাজনীতিতে কোণঠাসা বিএনপিকে কিছুটা স্বস্তির হাওয়া দিয়েছে এ সফর। আগামীতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার ফলাফল কি হতে পারে এর একটি ইঙ্গিতও রয়েছে। নেতারা বলছেন, ফেনীতে হামলার ঘটনায় ক্ষুণ্ন হয়েছে সরকারের তরফে দেয়া সহযোগিতার আশ্বাস। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মী ও তাদের বহনকারী গাড়িতে হামলা সরকারকে নৈতিকভাবে দুর্বল করেছে। গণমাধ্যম কর্মী ও তাদের বহনকারী গাড়িতে হামলা ও এ হামলার সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনকে জড়িয়ে একটি অডিও টেপ প্রচার সরকারের জন্য উল্টো বুমেরাং হয়েছে। মানুষ এটা বিশ্বাস করেনি কারণ শনিবার গাড়িবহরে হামলার পর দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ফেনী সদর আসনের সরকারদলীয় এমপির একটি বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। হামলার সময় ধারণকৃত হামলাকারীদের একটি ভিডিও চিত্রে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের কয়েকজন চিহ্নিত হয়েছেন। অন্যদিকে এ সফরের মাধ্যমে বিএনপির প্রতি গণমানুষের সমর্থন যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি ফুটে উঠেছে কিছু কিছু এলাকায় সাংগঠনিক দুর্বলতার চিত্রও। তবে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর-দক্ষিণ জেলা, কক্সবাজার জেলা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন খালেদা জিয়া। এটা ওই দুই জেলায় দলকে সাংগঠনিকভাবে গতিশীল করবে। এছাড়া খালেদা জিয়ার উখিয়া সফরকে কেন্দ্র করে ত্রাণ সমন্বয়, স্থানীয় নেতাকর্মীদের কার্যক্রম সমন্বয় ও বহরে অংশগ্রহণকারীদের দেখভালে দীর্ঘদিন পর একযোগে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন দলটির অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। সফরে জোটের শরিক দলগুলোর অবস্থান সম্পর্কেও কিছুটা উপলব্ধি ঘটেছে বিএনপির। বিএনপি চেয়ারপারসনের উখিয়া সফরকে পর্যালোচনায় দলটির নানাপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এসব কথা জানিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার সফরকে কেন্দ্র করে আগেরদিন থেকেই কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ডের নানা জায়গায় নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের একাধিক থানায় দায়ের হয়েছে নতুন নতুন মামলা। রাস্তায় মহড়া দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও লোহাগাড়ায় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে ব্যানার-ফেসটুন। তারপরও অদম্য মনোভাব দেখিয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন প্রথমদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যান। পথে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লায় রাস্তার দু’পাশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখেপড়ার মতো। কিন্তু ফেনীর চিত্র ছিল অন্যরকম। বিএনপি চেয়ারপারসনের নিজের এলাকা হিসেবে খ্যাত জেলা ফেনী। তার পূর্বপুরুষরা এ জেলার বাসিন্দা এবং ফেনীর একটি আসন থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন বারবার। কিন্তু খালেদা জিয়ার বহর কক্সবাজার যাওয়ার পথে ফেনীতে নেতাকর্মীদের কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি ছিল না। বহরে হামলাকারীরা যার সুযোগ নিয়েছে। বিষয়টি উঠে এসেছে নেতাদের পর্যালোচনায়। তবে ফেরার পথে ফেনীর প্রতিটি পয়েন্টে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি থাকলেও গাড়িবহরের পাশে পেট্রলবোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে দীর্ঘদিন কমিটি জটিলতায় থাকা ফেনী বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ভাবাচ্ছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় দিন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার মাত্র ১৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই ৮ ঘণ্টা সময় লাগে। দলীয় নেত্রীকে স্বাগত জানাতে প্রতিটি স্টেশনে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন নেতারা। বর্ণিল সাজসজ্জা, ফুল ছিটিয়ে বহরকে বরণ করেছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিএনপি। চট্টগ্রাম মহানগর, কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তরপ্রান্ত থেকে মইজ্জার টেক, চন্দনাইশ, সাতকানিয়ার কেরানীহাট, লোহাগাড়া বাসস্টেশন, চকরিয়ার চিরিঙ্গা, কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও ও রামুতে মানুষের অভাবনীয় উপস্থিতির কথা এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। ফেরার দিন রাতেও লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ায় মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখেপড়ার মতো। জোটের শরিক দল জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার জনগণ বিপুল উপস্থিতির মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে দিয়েছে একটি বার্তা। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের আশা, জামায়াতের দৃশ্যত অংশগ্রহণ ছাড়াও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় মানুষের এমন উপস্থিতি শীর্ষ নেতৃত্বের উপলব্ধির পরিবর্তন ঘটাবে। এদিকে জোটের শরিক দলের মধ্যে চন্দনাইশের গাছবাড়িয়ায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমের সমর্থকরা। কিন্তু দীর্ঘ এ সফরে কোথাও দেখা যায়নি জামায়াত নেতাকর্মীদের উপস্থিতি।
রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে খালেদা জিয়ার উখিয়া সফর পর্যালোচনায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতা ও বাংলাদেশের স্বার্থ দুটোকেই বড় করে দেখেছে বিএনপি। তাই প্রথম থেকেই আমাদের অবস্থান ইতিবাচক। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণে চারদিনের উখিয়া সফরে কোনো পথসভা করেননি বিএনপি চেয়ারপারসন। বরং এ সফরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের অবস্থান শক্ত হয়েছে। খালেদা জিয়া আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি যে জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন সরকার সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে উখিয়া পর্যন্ত দীর্ঘপথে রাস্তার দু’পাশে সাধারণ মানুষের যে স্বতস্ফূর্ত অবস্থান ছিল তার থেকেও কিছু বার্তা নিতে পারে সরকার। ধরপাকড়, বাড়ি বাড়ি অভিযানসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মানুষ তাদের ভোটাধিকার হরণ, মৌলিক অধিকার হরণ, নির্যাতন-নিপীড়নের নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। জনগণের এ প্রতিবাদকে আমলে নিলে সরকার অবশ্যই দ্রুত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন পর বিএনপি চেয়ারপারসনের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সফরে মানুষের এমন বিপুল উপস্থিতি নিশ্চয় বিএনপি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করবে। ড. আবদুল মঈন খান বলেন, উখিয়াতে বিএনপি চেয়ারপারসন স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন- রোহিঙ্গাদের প্রতি কেবল সাহায্যের হাত  বাড়িয়ে দিলেই হবে না, যা বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যেই করেছে। তাদের নিজ বাসভূমে ফিরিয়ে দিয়ে সেখানে তাদের আর্থসামাজিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণই এ সমস্যার একমাত্র অর্থবহ সমাধান। স্পষ্টতই সরকার এতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কর্মসূচি উপলক্ষে ঢাকা থেকে উখিয়া পর্যন্ত দীর্ঘপথ পরিক্রমণে বিএনপি চেয়ারপারসনকে রাস্তার দুপাশে লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দন আওয়ামী লীগের সকল হিসেব-নিকেষকে বানচাল করে দিয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, মানবিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের সহানুভূতি জানানোই ছিল বিএনপি চেয়ারপারসনের এ সফরের লক্ষ্য। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের সরকারকে যে আহ্বান জানিয়েছেন সেখানে দলীয় নয়, জাতীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এ সফরে আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও লাখ লাখ মানুষ যেভাবে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে তা নতুন করে প্রমাণ করেছে বাংলাদেশে তার জনপ্রিয়তার চূড়া কত উঁচু। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে যে বিপুল জনজোয়ার নেমেছিল তা সত্যিই অভাবনীয়। খালেদা জিয়াও রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোর সঙ্গে মানসিকভাবে একাত্ম অনুভব করেছেন। রাস্তায় রাস্তায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সশস্ত্র টহল, মামলা-হামলা, অপপ্রচারের মধ্যে বিপুল এ সমর্থন বিএনপি নেতৃত্ব, সারা দেশের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করবে। ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উখিয়া সফরে যাওয়া-আসার পথে মানুষ যে হৃদয় নিংড়ানো অভিবাদন ও সমর্থন প্রকাশ করেছে তা আমাদের  অভিভূত করেছে। বর্ণিল সাজসজ্জা, বিপুল উপস্থিতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ বিএনপি চেয়ারপারসনকে যে আন্তরিকতায় বরণ করেছে সেটা এককথায় অভূতপূর্ব। এতে কয়েকটি বিষয় প্রমাণ হয়েছে- বিএনপি সুসংহত ও জনসমর্থিত দল। সরকার শত চেষ্টা করেও মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার করতে পারেনি। ব্যাপক নির্যাতনের পরও নেতাকর্মীরা যে মাঠে আছে, মানুষ যেভাবে এসেছে সেটাকে রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ফেনী ও মিরসরাইয়ে গাড়িবহরে যে হামলা হয়েছে সেটা নিশ্চিতভাবেই সরকারি দলের কর্মকাণ্ড। তবে যেখানে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটেছে সেখানে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও কিছুটা দ্বন্দ্ব-দূরত্ব রয়েছে। হামলার ঘটনাগুলোর মাধ্যমে সে দূরত্বের একটি আঁচও প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে দলকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে পারলে কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সুযোগ পেতো না। সামনের দিনগুলোতে আমাদের সে দূরত্বগুলো দূর করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031