আদেশ ও দিকনির্দেশনা দেন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উচ্চ আদালত প্রায়ই রায় । কিন্তু তা পুরোপুরি পালনে নিষ্ক্রিয়তা, উদাসীনতা ও অবহেলার পরিচয় দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বিগত কয়েক বছরে জনস্বার্থ ও জনগুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে যেসব আদেশ ও দিকনির্দেশনা এসেছে তা যথাযথভাবে এবং পুরোপুরি পালন হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশকে অমান্য করছেন সংশ্লিষ্টরা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানা আদালত অবমাননার শামিল। যাদের বিষয়ে উচ্চ আদালত নির্দেশনা পালনের আদেশ দিয়েছেন তারা যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদ্যোগ বা সমস্যা প্রশমনে ব্যবস্থা না নেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যাবে।

 বিরম্বনার এক নাম দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন। কোনো কোনো প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের লেখা এমনই দুর্বোধ্য যে এ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় রোগী ও তার স্বজনদের। ২০১৬ সালে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হবার পর এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১০ই জানুয়ারি বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে রুল ও নির্দেশনা জারি করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদাসীন চিকিৎসকরা। আগের মতোই তারা দুর্বোধ্য অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লিখছেন।
২০১২ সালে হাইকোর্ট বিভাগ এক রায়ে ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালালে চালকদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও নির্দেশনা দেয়া হয় পুলিশকে। ২০১৭ সালের ২৭শে মার্চ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ফুটপাথ দিয়ে মোটরসাইকেল চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭-এর খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ। সরজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মূল সড়কে যানজট শুরু হলেই ফুটপাথগুলোতে অবাধে ও দাপটে চলছে মোটরসাইকেল। আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটরযান অধ্যাদেশ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী রাস্তায় বা জনগণের চলার জায়গায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ জন্য দায়ী ব্যক্তিকে জেল এবং জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। তবে, আদতে ফুটপাথ দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোর অপরাধে কারো সাজা হয়েছে এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন আইনজীবীরা।
গত ৫ই নভেম্বর হাইকোর্ট এক আদেশে সারা দেশে বিভিন্ন যানবাহনে থাকা পরিবেশ দূষণকারী হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ঢাকার পাঁচটি এলাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার যেসব স্থানে শব্দ দূষণ বেশি হয় সেসব স্থানে পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করে শব্দ দূষণের মাত্রা নির্ধারণ ও শব্দ যাতে বেশি না হয় সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয় বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। এর আগে রাজধানীতে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস
অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে গত ২২শে আগস্ট হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি রিট আবেদন করা হয়। ২৩শে আগস্ট এক আদেশে ঢাকার সড়কগুলোতে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ২৭শে আগস্টের পর কোনো যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দ করা, হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধের পাশাপাশি বাজারে থাকা সব হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করার নির্দেশ দেয়া হয়। ৮ই অক্টোবর এক আদেশে ঢাকা মহানগরে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারকারী যানবাহনের চালক ও মালিককে ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় সব হাইড্রোলিক হর্ন জমা দেয়া ও থানায় জমা হওয়া হাইড্রোলিক হর্ন ধ্বংস করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয় আদালত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এখনো রাজধানীসহ সারা দেশে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। জনবান্ধব ও জনস্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাইকোর্টে বেশকিছু রিট আবেদন করেছিলেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। মানবজমিনকে তিনি বলেন, প্রচলিত সংবিধানে বলা আছে, প্রশাসন এবং জনগণ সকলেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে বাধ্য। আমাদের সবাইকে এটি জানতে, বুঝতে ও মানতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেকে নিষ্ক্রিয়তা ও নেতিবাচক মনোভাবের পরিচয় দেন। এ কারণেই উচ্চ আদালতের নির্দেশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, যারা উচ্চ আদালত থেকে আদেশটি নিলেন তারা যদি লেগে থাকেন এবং আদালত অবমাননার হাতিয়ারকে ব্যবহার করেন তাহলে আদালতের নির্দেশ সংশ্লিষ্টদের না মানার কোনো উপায় নেই। মনজিল মোরশেদ আরো বলেন, প্রশাসনে যারা আছেন তারা যদি নিষ্ক্রিয়তা দূর করে আদালতের নির্দেশ পালনে আন্তরিক ও সক্রিয় হন তাহলে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব।
ট্রাফিক জ্যামের ভোগান্তি লাঘবে রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২০১২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট আদেশ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে হাইকোর্টের এই আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বংশাল, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি ও শাহবাগ থানার ওসির (ভারপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না- এ মর্মে রুল জারি করে আদালত। এর আগে ২০০১ সালে জনস্বার্থে করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে রাজধানীর ফুটপাথ ও চলাচলের পথকে জনসাধারণের ব্যবহার এবং পথচারীদের জন্য পরিচ্ছন্ন ও উন্মুক্ত রাখার নির্দেশ দেয়। বিভিন্ন সময়ে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া হলেও কার্যত তা আলোর মুখ দেখেনি। সরজমিনে ঢাকার মতিঝিল, গুলিস্তান, জিরো পয়েন্ট, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে আগের মতোই ফুটপাথগুলো দখলে রয়েছে। ফলে, ওই এলাকায় যানজটও চিরাচরিত বিষয়।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে ঢাকনা ছাড়া ট্রাক বা ভ্যান দিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন বন্ধ এবং রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণের পদক্ষেপ নিতে গত ১৬ই অক্টোবর নির্দেশ দিয়েছিল বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলনের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিত্রে এ নির্দেশ দেয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকোর্টের এ নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করছে না সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এখনো ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে ঢাকনাবিহীন গাড়িতে করে বর্জ্য অপসারণের কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে হাইকোর্টের বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সময়ও মানা হচ্ছে না ঠিকমতো।
ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু এই চারটি নদীকে রক্ষা করতে নদী তীরবর্তী অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদে ২০০৯ সালের ২৫শে জুন এক আদেশে কয়েকদফা নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। আদেশে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সীমানায় পাকা খুঁটি বসানো, নদীর তীরে হাঁটার পথ নির্মাণ, নদীর তীরে বনায়ন ও নদীগুলো খনন করাসহ ১২ দফা নির্দেশনা দেয় আদালত। ভূমি, স্বরাষ্ট্র, অর্থ, নৌপরিবহন, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে নদী রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাস্তবে তা আলোর মুখ দেখেনি। জনস্বার্থে দেয়া উচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছেনা- এটি মানতে রাজি নন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। মানবজমিনকে বলেন, কে বললো বাস্তবায়ন হয় না। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না হলে তো আদালত অবমাননা হয়। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের কোন কোন নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা আপনারা চিহ্নিত করেন। আপনারা লেখেন। লিখলেইতো জনসচেতনতা বাড়ে।
Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031