উন্নয়নশীল দেশের পুরো যোগ্যতা অর্জনের পর বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প। সফলভাবে এই চ্যালেঞ্জ
উত্তরণ করতে পারলে এই খাতকে টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর সম্ভাবনাও দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। রানা প্লাজায় ধস, হলি আর্টিজানে হামলার পর অনেকটা সংকটে পড়া পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে উৎপাদন খরচ বাড়া ও বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় নতুন সংকটে ভোগার কথা বলছেন শিল্পমালিকরা। নানা সমস্যা এ খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিও কমেছে। এমন অবস্থায় সামনে উন্নয়নশীল দেশের পুরো যোগ্যতা অর্জন হলে ২০২৭ সাল থেকে জিএসপি সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ।

নির্ধারিত শর্ত পূরণ করলে ওই সময় থেকে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে ওই সুবিধা পেতে ২৭টি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রম অধিকার, শ্রম পরিবেশ ও সুশাসন। চলমান পরিস্থিতিতে এসব শর্ত বাস্তবায়নও কঠিন বিষয় বলে মনে করছেন পোশাক শিল্পমালিকরা। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগই আসে পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক খাতের বড় বাজার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় জিএসপি সুবিধা স্থগিত হলে রপ্তানি আয়ে পোশাক শিল্পের ওপর চরম আঘাত আসবে।
বিশ্লেষকরা জানান, বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিনা শুল্কে রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের ২৭ বিলিয়ন ডলারই আসে এসব দেশ থেকে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কম সুদে বা বিনা সুদে ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। ২০২৭ সালের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা কমে যাবে। রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা সংকুচিত হতে পারে। বিশেষ করে দেশের রপ্তানি আয়ের বড় খাত পোশাকশিল্পের রপ্তানি আয় কমে যাবে বলে মনে করছেন তারা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, উন্নয়নশীল দেশের পুরো মর্যাদা পেলে বাংলাদেশ ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। তার মতে, এর বড় প্রভাব পড়বে পোশাকশিল্পে।
পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, বিদেশে বাংলাদেশের তৈরিপোশাকের দাম একদিকে যেমন কমছে, তেমনি উৎপাদন খরচও প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ফলে পোশাক খাতকে নানাবিধ সংকট মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুযায়ী পোশাককর্মীদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হচ্ছে। কিন্তু সে অনুপাতে পোশাকের দাম বাড়ছে না। অন্যদিকে প্রতিযোগী দেশগুলোর সরকার সুযোগ-সুবিধার দেয়ার কারণে তাদের সক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমাদের যে চ্যালেঞ্জ সেটা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায়। নতুন স্বীকৃতির ফলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া সেসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছি। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবো। এর পর আমাদের জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া নিয়ে কাজ করতে হবে। ওইটাই হবে আমাদের পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বতর্মানে যেসব সুবিধা পাচ্ছি সেসব সুবিধাগুলো পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ থাকবেই। চ্যালেঞ্জ ছাড়া সামনে যাওয়া যাবে না। এলডিসি থেকে বের হচ্ছি এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকাটাই স্বাভাবিক। চ্যালেঞ্জ উত্তরণ করতে পারলে পোশাক শিল্প একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে।
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর মতে, পোশাক খাতে সব সময় চ্যালেঞ্জ ছিল আগামীতেও থাকবে। বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ায় চ্যালেঞ্জ আরো বাড়লো বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমাদের সব চ্যালেঞ্জ পরিকল্পিতভাবে মোকবিলা করতে হবে। সেজন্য দক্ষতা অর্জন করতে হবে। দেরি না করে এখন থেকেই কৌশল নির্ধারণ শুরু করতে হবে। এর মধ্যে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া নিয়ে এখনোই কাজ শুরু করে দিতে হবে। এছাড়া বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা পেয়ে আসছে। ২০২৭ সালের পর আমরাও পাবো। তবে সেটা পাওয়ার জন্য আমাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যদি না পাই তাহলে আমাদের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। সালাম মুর্শেদী বলেন, জিএসপি প্লাস সুবিধার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক জোনগুলো পুরোপুরি সচল করতে হবে। রপ্তানি আয় বাড়াতে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি দেশের কারখানাগুলোতে জ্বালানি সহায়তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। মোটামুটি এগুলো করতে পারলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে বলে মনে করেন তিনি।
সম্প্রতি ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ’ শীর্ষক সেমিনারে ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসিয়া তিরিঙ্ক বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। এরপর শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ এবং সুশাসন বিষয়ে ২৭টি কনভেনশন বাস্তবায়ন করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে সেটি পরীক্ষিত হতে হবে। তাহলে ইইউতে শুল্কমুক্ত বাজার পাবে বাংলাদেশ।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরি করা সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, গত দুই বছরে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে গার্মেন্টস সেক্টরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৮ শতাংশ। গত চার বছরে প্রায় ১২০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করতে হবে।
উল্লেখ্য, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৮.৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গেল অর্থবছরে (২০১৬-১৭) প্রাথমিক ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৩৪.৬৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। চলতি অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে ৩৭.৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য পূরণে প্রথম আট মাসেই ২৪.৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা ছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে রপ্তানি হয়েছে ২৪.৩৯ বিলিয়ন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ০.০২ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তৈরিপোশাকের ওভেন খাতে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এলেও নিটওয়্যার খাতে এসেছে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031