জনগণের অর্থের সদ্ব্যবহার না করা, নিম্ন মজুরি ও কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ার মতো বিষয়গুলোর বৈষম্য বৃদ্ধির ভূমিকা রাখছে। উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি ও অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যবধান, গত ৬ মে দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ধরন বিশ্লেষণম্ব শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বক্তারা বলেন বলে পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ।

খবরে বলা হয়, আইসিএবি’র প্রেসিডেন্ট দেওয়ান নুরুল ইসলাম স্বাগত ভাষণে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করেছি। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির কারণেই এটি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এ অর্জন ধরে রাখতে হলে আমাদের পণ্যে বৈচিত্র আনার মাধ্যমে রফতানি বাড়াতে হবে। সেমিনারে প্রধান অতিথি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. কামালউদ্দিন আহমেদ তাঁর ভাষণে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়ার কারণে বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার বিশাল চাপ নিয়ে ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে। তবে বজায় রাখতে পারাটা চ্যালেঞ্জিং। এজন্য সারাবিশ্বই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। প্রতি বছরই নতুন শ্রমশক্তি যোগ হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। এজন্যে বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সুশাসন ছাড়া কোন কিছুই সম্ভব হয় না। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আইসিএবি’র কাউন্সিল মেম্বার শাহাদাত হোসেন সরকারি তহবিল ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আয় বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে আসন্ন জাতীয় বাজেটে সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বারোপ করেন। দেশের প্রায় ৫২ লাখ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন, যারা সঠিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। এজন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দে জোর দিতে হবে।

আইসিএবি’র সেমিনারে প্রত্যেকের বক্তব্যই সুচিন্তিত ও মান্য করার মতো। ৭ শতাংশের ওপরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে যতই গর্ব করা হোক না কেন এতে আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ছোট হলেও এর জনসংখ্যা ১৬ কোটি; তাই আয়ের বিচারে এর স্থান বিশ্বের অনেক দেশের উপরে থাকবে এমন ধরে নেওয়া ভ্রান্তিমূলক। শুধু মাথাপিছু আয় বা জিডিপির দিকে তাকালে বাংলাদেশের অনগ্রসরতার পুরো চিত্রটি পাওয়া যাবে না। মাথাপিছু আয় একটি গড় হিসেব মাত্র। দেশের দুই কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যাদের আয় দৈনিক ১ ডলারের নিচে। সভ্য জগতের উপযুক্ত অন্ন–বস্ত্র–বাসস্থান–চিকিৎসা এই একুশ শতকে পৌঁছেও মিলছে না। উপরতলার একটি শ্রেণি প্রবৃদ্ধির সুবিধা উপভোগ করে ফুলে ফেঁপে উঠছে।

শহরে প্রকৃত মজুরি হার মোটের ওপর বেড়েছে সত্য, কিন্তু সেটা আসলে বেড়েছে একেবারে ওপরের ভাগে। আর সব থেকে নিচের ভাগে বাড়েনি বললেই চলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গেল কয়েক বছরে প্রকৃত মজুরি বাড়ে নি। তাই একথা স্পষ্ট, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আলো দেখা গেলেও তা এখন পর্যন্ত মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে আলোকিত করেছে, বাকিরা যেই তিমিরে ছিল, আজো সেই তিমিরে। ইতিহাসের কথা হলো, দেশে যত উন্নতি ঘটে, তত ছোট হয়ে আসে কৃষি ক্ষেত্র। জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে ছোট হয়ে আসে। আবার কর্মসংস্থানের দিক থেকেও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকে। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোয় কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকের অনুপাত মোট কর্মসংস্থানের ২–৪ শতাংশের বেশি নয়। আমাদের সমস্যাটা এখানেই। আমাদের জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে কৃষির অবদান কমে এলেও মোট শ্রমিকের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশই এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো শ্রমিকদের একটি বড় অংশ উন্নয়নের চৌহদ্দির বাইরে কৃষি ক্ষেত্রে রয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রবৃদ্ধির হার নিতান্তই শ্লথ। আসলে আমাদের দেশের জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। এছাড়া আছে গার্মেন্টস ও কৃষি। অনানুষ্ঠানিক খাতের ভূমিকাও কম নয়। অথচ এসব ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের আয় এবং জীবনের নিরাপত্তা দুটিই অনিশ্চিত। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়লে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বড় দেখায়, জিডিপি বাড়ে। উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য সেবা জুগিয়ে দেশের পিছিয়ে পড়াদের নতুন পরিবর্তনের উপযোগী করে তুলতে হবে। এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা যদি অর্থনীতির সব দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি, তাহলে কিছুই বদলাবে না। কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে অর্থনীতির সুফল ভোগ করে যাবে, আর বাকিদের বিশেষ করে গরিবদের অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যাবে–সে স্থবিরতা আমাদের কাম্য নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ভালো হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কৃষক–শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। নীতি নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ভালো হচ্ছে, মানে দেশের মানুষের কল্যাণ হচ্ছে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আইসিএবি সেমিনারে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি ও অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে। জনগণের জীবন মান উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় বৈষম্য। যেসব নীতি ও ব্যবস্থার ফলে সমাজে বৈষম্য কমে আসতে পারে। তা কখনো বাস্তবায়িত হয় নি। যেমন– সুশাসন প্রতিষ্ঠা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, শহর ও গ্রামের মধ্যে কমিয়ে আনা।

সর্বব্যাপী দুর্নীতি বৈষম্যকে আরো প্রকট করছে। এসব নিয়ে সরকারি, বেসরকারি, জাতীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে যেতে পারে, দারিদ্র্য বিমোচনের গতি রুদ্ধ না হলেও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা এবং সর্বোপরি সামাজিক সংহতি ও শান্তি বিনষ্ট হতে পারে। এসব কারণে সব পর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে সচেতন হয়ে নিতে হবে, যেন বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরা যায়। সেক্ষেত্রে সরকারের ভাবনায় পরিবর্তন জরুরি।

Share Now
November 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930