সংস্কৃতি মন্ত্রী ও নাট্য ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি চট্টগ্রামে সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান এমপি চট্টগ্রামে সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ডি.সি হিলের নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেনক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় নগরীর সার্কিট হাউসে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স স্থাপন সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সভায় রাগ ঝাড়লেন সংস্কৃতিকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। সভায় আসাদুজ্জামান নূর এমপি বলেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বিনোদনে র তীর্থক্ষেত্র ডিসি হিল। দশকের পর দশক ধরে ডিসি হিলে অবারিতভাবে চলে আসছে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। চট্টগ্রামের মতো একটি শহরে, ঐতিহ্যবাহী একটি স্থানে, বহুদিন ধরে অনুষ্ঠান করতে পারছে না মানুষ, এটি আমাদের কাছে খুবই বিস্ময়কর। স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে নিন্দা জানানো হয়েছে। ডিসি সাহেবের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা তিনি করতে পারেন না। চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীকেও দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আপনারা জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি ও সংস্কৃতিকর্মীরা বসুন, কমিটি করে নীতিমালা তৈরি করুন। ডিসি হিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিন। ডিসি হিলে অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে – এটা কারো কাম্য নয়। সভার একপর্যায়ে চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন মন্ত্রীকে জানান, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি ছাড়া নগরীতে কোন উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান হচ্ছে না। ডিসি হিলে অনুষ্ঠান বন্ধ আছে।
মতবিনিময় সভায় সংস্কৃতি কর্মীরা অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের বাংলো সংলগ্ন ডিসি হিলের মুক্ত মঞ্চে চট্টগ্রাম মহানগরীর অধিকাংশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। একেকবার একেকটা অজুহাত তুলে সংস্কৃতিকর্মীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। সামপ্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কৃতিবান্ধব সরকার সংস্কৃতি কর্মীদের পক্ষে যে কাজ করে যাচ্ছে এ সিদ্ধান্ত তার বিপরীতমুখী অবস্থান অবলম্বন করছে।
সংস্কৃতি কর্মীদের সাথে সহমত পোষণ করে সংস্কৃতি মন্ত্রী বলেন, ডিসি হিলে বহু বছর ধরে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। সেই অনুমতিটা চট্টগ্রামের ডিসিই একসময় দিয়েছিল। অপ্রিয় সত্য হলো, আমাদের ডিসি সাহেবরা যখন বক্তব্য দেন তারা কিন্তু জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এটিকে দমন করার জন্য সংস্কৃতি চর্চার কথা তুলে ধরেন। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে যখন আসেন, তারা নতুন নতুন নিয়ম তৈরি করেন। এটি দুঃখজনক।
আসাদুজ্জামান নূর এমপি আরো বলেন, আমাদের প্রশাসনতো বাইরের কেউ নয়। এটিতো বিদেশি বা পাকিস্তানি প্রশাসন নয়। বাংলাদেশের প্রশাসন হয়েও, যদি দেশের সংস্কৃতি নিয়ে কথা না বলে, তাহলে তারা কার জন্য কথা বলবে?
এসময় জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা ডিসি হিলে অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে মন্ত্রীকে জানালে সংস্কৃতিকর্মী ও প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান প্রতিবাদ করেন।
রাশেদ হাসান ওই কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি অসত্য তথ্য দিচ্ছেন। ডিসি হিলে কোন অনুষ্ঠান আপনারা করতে দিচ্ছেন না। আপনারা অনুষ্ঠান বন্ধের জন্য যেসব যুক্তি দিচ্ছেন সেগুলো হাস্যকর যুক্তি। আপনারা সময় নির্ধারণ করে দেন কতক্ষণ অনুষ্ঠান করা যাবে। কিন্তু আপনারা অনুষ্ঠানই বন্ধ করে দিলেন। আসলে আপনারা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। আপনারা বাসার গণ্ডিতে কেউ যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য অনুষ্ঠান বন্ধ করেছেন। ডিসি হিল যদি আমলার বাসভবন হয়, তাহলে আমরাও বলতে পারি এটা সংস্কৃতির পীঠস্থান। আমলারা এটা দখল করে রাখতে পারেন না।’
মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. নুরুল আলম নিজামী, কবি আবুল মোমেন, নাট্য ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইকবাল হায়দার, সংস্কৃতি সংগঠক দেওয়ান মকসুদ, নগর পরিকল্পনাবিদসহ অন্যান্য সংস্কৃতিকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, এত বড় জায়গা নিয়ে ডিসির থাকার যৌক্তিক কোন কারণ নেই। শহরের মাঝখানে এত বড় জায়গা জুড়ে ডিসির বাংলো অন্য কোথাও নেই। রাজশাহী বা অন্যান্য জেলাতে ডিসির বাংলো শহরের এক প্রান্তে। ডিসি হিলে অনুষ্ঠান করা প্রসঙ্গে সংস্কৃতি কর্মী ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা নীতিমালা হতে পারে অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রাপ্তিতে যা প্রযোজ্য হবে।
আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসান বলেন, ডিসি হিলে অনুষ্ঠান করতে না দেওয়ার কারণ হিসেবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সংস্কৃতি কর্মীরা অনুষ্ঠানের অনুমতি নেওয়ার পর সিটি কর্পোরেশনকেও চিঠি দেয়, যার মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এসে অনুষ্ঠান শেষে জায়গাটা পরিষ্কার করে দেয়। বলা হচ্ছে সাউন্ড পলিউশনের কথা। এসব সমস্যা এক সভাতেই সমাধান হয়ে যায়। মূল কথা হলো– ভালো লাগুক বা না লাগুক, আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে ডিসি সাহেব ডিসি হিলকে নিজস্ব বাসভবন বানিয়ে রেখেছেন। রাশেদ হাসান আরো বলেন, ডিসি হিলে অনুষ্ঠান হবে মানের ভিত্তিতে। জেলা প্রশাসক বা বিভাগীয় কমিশনারের পছন্দের ভিত্তিতে অনুষ্ঠান হতে পারে না।
প্রসঙ্গত: প্রকৃতির স্নেহধন্য এ নগরীতে সবুজে ঘেরা যে দু’একটি দৃষ্টিনন্দন বিনোদন স্থান রয়েছে, ২০ দশমিক ৩২ একর আয়তনের ডিসি হিল পার্ক সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রবিন্দু জিরো পয়েন্ট থেকে ১ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি গাছ–গাছালির নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য; তার নিঃশব্দ আহবান কে–ইবা উপেক্ষা করতে পারে? চারদিক ফুলের নার্সারি বেষ্টিত স্থানটার কদর সর্বস্তরের মানুষের কাছে দিন দিন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, এখানকার আলো–বাতাসে গড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন সবার কাছে প্রাণবন্ত এক শান্তিময় অনুষঙ্গ। ইট কাঠ পাথরে ঢাকা যান্ত্রিক এই নগরীতে তাই মানুষ তার শেকড়ের টান অনুভব করতে সময় পেলেই এখানে ছুটে আসে। সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানতো আছেই, সাথে শরীর চর্চা থেকে ক্রিকেট খেলা, ভালোবাসাবাসি থেকে কনে দেখা কিংবা শুধুই আড্ডার ছলছুতোয় যেকোন বয়সের মানুষ এখানে আসে, দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয়; ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যায় প্রকৃতির শুদ্ধতা আর আগামীর পথে ছুটে চলার প্রেরণা।
