সরকারের প্রশাসনিক অনুমোদন লাভের পর গত শুক্রবার মাতারবাড়িতে জমির সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। প্রথম দফায় ২৯৪ একর ভূমি হুকুম দখল করে কাজ শুরু করা হবে। দ্বিতীয় দফায় বাকি ভূমিও হুকুম দখল করা হবে। বহুল প্রত্যাশার মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে ১ হাজার ২২৫ একর ভূমি হুকুম দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের মধ্যে মাতারবাড়িতে জেটি নির্মাণের কার্যক্রম
শুরু হবে। ২০২৪ সালে জেটিতে দশ হাজার টিইইউএস কন্টেনারবাহী জাহাজ ভিড়ানোর মাধ্যমে স্বপ্নের গভীর সমুদ্র বুন্দরের অপারেশন শুরু করা হবে। জাপান সরকারের ২ হাজার ৬৫৫ মিলিয়ন ইয়েনের ঋণ সহায়তায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৬ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানোর মাধ্যমে এই বন্দর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শিপিং বাণিজ্যের হাব হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের ‘অবাধ ও মুক্তি ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলের’ অংশ হিসেবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে জাপান সরকার। একই সাথে শ্রীলংকা এবং মিয়ানমারেও বন্দর নির্মাণে অর্থায়ন করছে জাপান। জাপানি ইয়েনে এই ঋণ প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে জাপানের উদ্দেশ্য হলো, মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে এশিয়ার সাথে আফ্রিকা পর্যন্ত সমুদ্র পথে যাতায়াত নিশ্চিত করা। পাশাপাশি মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দাওয়েই এবং শ্রীলংকার উত্তরাঞ্চলের ত্রিকোনমালিতেই একই ধরনের বন্দর প্রতিষ্ঠায় অর্থায়ন করছে জাপান।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের জন্য গত বছরের ১৪ জুন ঢাকায় স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তির আওতায় ২ হাজার ৬৫৫ মিলিয়ন ইয়েন অর্থ দেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে। এই অর্থ দিয়ে মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণ করতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ সুদে এই ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। দশ বছরের গ্রেস পিরিয়ডের পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আবার অর্থ ছাড়ের শর্তগুলোর মধ্যে বন্দরের কার্যক্রম শুরু পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। ডিজাইন এবং প্ল্যানিং থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সময়ে উপরোক্ত অর্থ খরচ করতে হবে। আবার ছয় বছর সময়ের মধ্যে অর্থ ব্যয় করার শর্ত রয়েছে। এতে করে আগামী ছয় বছরের মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম শুরু করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
মাতারবাড়ি বন্দরের জেটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তুলতে ১ হাজার ২২৫ একর ভূমি লাগবে। এই ভূমি অধিগ্রহণে বন্দরের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১২শ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে সরকারের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রথম দফায় ২৯৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করবে। দ্বিতীয় ধাপে বাকি ৯৩১ একর ভূমি হুকুম দখল করা হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ গত শুক্রবার ১ হাজার ২২৫ একর ভূমি জরিপের কাজ সম্পন্ন করেছে। যেখান থেকে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হবে সেই স্থানটি চিহ্নিত করে সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বন্দরের সীমানায় লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসময় বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ, সদস্য (অ্যাডমিন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মোহাম্মদ জাফর আলম, সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) কমডোর আকতার হোসাইন, চিফ প্ল্যানিং মাহবুব মোর্শেদ চৌধুরী, চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ, ডাইরেক্টর ট্রাফিক এনামুল করিম, ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (অ্যাডমিন অ্যান্ড প্ল্যানিং) মোহাম্মদ জাফর আলম বলেন, মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজের মধ্যেই আসলে বন্দরের কাজ রয়েছে। কয়লাবাহী জাহাজ আনার জন্য ১৪.৩ কিলোমিটার লম্বা এবং আড়াইশ মিটার প্রস্থের চ্যানেল ড্রেজিং করে গভীরতা ১৬ মিটার করা হয়েছে। এর সাথে পাশে আর একশ মিটারের ড্রেজিং শেষ হলেই মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য চ্যানেল পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ড্রেজিং করে তোলা মাটি দিয়ে আমরা বন্দরের অবকাঠামো গড়ে তোলার নির্ধারিত জায়গাগুলোর উন্নয়ন সম্পন্ন করব। এতে করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা চ্যানেল এবং অবকাঠামো গড়ে তোলার ভূমি তৈরি করতে সক্ষম হব। ২০২১ সালে জেটি নির্মাণের কাজ শুরু করব। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ জেটি নির্মাণের কাজ শেষ করব। ২০২৪ সালের শুরুতেই এই জেটিতে দশ হাজার টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে আসা জাহাজ বার্থিং দেব।
সংশ্লিষ্টরা সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ৪৬০ ফুট দীর্ঘ একটি কন্টেনার টার্মিনাল এবং ৩০০ ফুট লম্বা একটি মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বর্তমানে ১৯০ মিটার লম্বা ৯.৫ মিটার ড্রাফটের কন্টেনার ভ্যাসেলে ১৪শ টিইইউএস থেকে ১৮শ টিইইউএস কন্টেনার বহন করতে পারে। কিন্তু মাতারবাড়ি ডিপ সী পোর্টে ৩০০ মিটার লম্বা ১৬ মিটার ড্রাফটের দশ হাজার টিইইউএস কন্টেনারবাহী জাহাজ অনায়াসে ভিড়ানো সম্ভব হবে। মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের একেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের পাঁচটি জাহাজেরও বেশি কন্টেনার পরিবহন করতে পারবে। এই সক্ষমতা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ জাফর আলম।
গতকাল তিনি আজাদীকে বলেন, মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর এখন আর স্বপ্ন নয়, সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমরা ইতোমধ্যে কনসালটেন্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। নেদারল্যান্ড, জাপান এবং ভারতের খ্যাতনামা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। আগামী ১২ মার্চ টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। নির্বাচিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে আমরা দ্রুত মনোনয়ন দিয়ে কাজে নামাব। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পুরো প্রকল্পের ডিজাইন, ড্রয়িং, সুপারভিশনের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারটিও দেখভাল করবে। নির্মাণের পরেও এক বছর তারা দায়িত্ব পালন করবে।
অপর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরই ভবিষ্যতে দেশের শিপিং বাণিজ্যের হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তিনি বলেন, মাতারবাড়ি বন্দর পুরোদমে চালু করতে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। মাত্র এগার বছরের মধ্যেই এই টাকা উঠে আসবে। চৌদ্দ মিটারের বেশি ড্রাফটের যেকোনো বন্দরই গভীর সমুদ্র বন্দর।
| M | T | W | T | F | S | S |
|---|---|---|---|---|---|---|
| 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 |
| 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 |
| 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 |
| 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 |
| 29 | 30 | 31 | ||||
