১৯৫২ সালে আমাদের ছেলেরা- জব্বর, বরকত, রফিক, সালাম ভাষার জন্য রাজপথে
প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আমাদের মন পুরোপুরি ‘বাংলামুখি’ নয়। এক ভারতীয়
অধ্যাপক আমাকে বলেছেন, ‘এ নিউ ল্যাংগুয়েজ হ্যাজ বরণ’, নতুন এক ভাষার জন্ম
হয়েছে। আমি বলি, “সেটা কোন্ ভাষা ভাইয়া? তিনি বল্লেন, ওটার নাম ‘ইন্ডিয়ান
ইংলিশ’। ভারতের কোন তামিল- একজন তেলেগুভাষীর সাথে কি ভাবে কথা বলে? তখন ওরা
“লিংগুয়া ফ্রাংকা” ব্যবহার করে। সেটা হল “ইন্ডিয়ান ইংলিশ।” আমি এক
কর্নাটকির বাসায় গিয়েছি। আমরা টিভি সেটের সামনে বসেছি। ওই পরিবারের ছোট্ট
শিশু মহা দিগদারী করছে। কাঁদছে আর বলছে- “ডাড্ডি কার্টু। ডাড্ডি কার্টু।”
আমি কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। ভাবী চা নাস্তা ইডলি ওডা পরিবেশন
করছিলেন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমাকে বল্লেন, “প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।” বলেই
চ্যানেল বদলে “ইউটিউব” দিয়ে দিলেন। বাচ্চা ছোট্ট কচি হাতে তালি দিয়ে নেচে
নেচে বলতে শুরু করে, “এ আই- এ আই, মাইন খ্রাফ্ট।” (মানে ইউটিউবে মাইন
ক্রাফ্ট চলছে। এর এডমিন হচ্ছে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স। মানে কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা।) আমি ভাবীকে বল্লাম, “ডাড্ডি কার্টু” ক্যায়া চিজ? ভাবী
বল্লেন, “উসনে কার্টুন দ্যাখনেকা লিয়ে, রো রাহা থা। বোলা থা্ত- “ডেডি
কার্টুন।” মানে, বাবা, আমি কার্টুন দেখব। এই বাচ্চার ভাষা ইন্ডিয়ান ইংলিশ
এবং তার ধ্যান ধারনা ও ইন্ডিয়ান ইংলিশ ভিত্তিক। আর আমাদের বাচ্চারা এখন
বাংলার পরিবর্তে “বাংলিশ” ব্যবহার করে। এর পেছনে যুক্তি হচ্ছে, উই কেয়ার ফর
ফ্লুয়েন্সি, গিভিং লেস্ স্ট্রেস অন এ্যাকুরেসি।
১৯৯০ সালে মাদ্রাজে হংকং ভিত্তিক এক হোটেলে ছিলাম- নাম “ঠবব ুবং”। ফ্লোর
সুপার ভাইজারের নাম রামা কিষন। সে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করে ভাল চাকরি
তালাশে আছে। একদিন তাকে ডাকি “রামা কিষন? মানি চেঞ্জ কর স্যাকেগা? ডলার
ভাংগাতে পারবে?” সে বলে, “হোয়াই নট্ স্যার? গিভ মি ওয়ান মিনিট টাইম, আই
শেল টোল্ড ইউ।” ভুলটা ধরতে পারছেন? ভুল সত্ত্বেও আমার কাছে তার বক্তব্য
কম্যুনিকেট হয়। যেমন, আপনারা ফেসবুকে লিখেন (ঐড় িজ ট) হাউ আর ইউ? এটা
ফ্লুয়েন্ট ইংলিশ। এটাকে বলা হচ্ছে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। ওরা আমাদেরকে বলে
গ্রামারিয়ান। ওরা বলে, যা কম্যুনিকেট হয় ওটা ভাষা। কম্যুনিকেশনের জন্য
ভাষা। এই নব্য ভাষা সংস্কৃতির বন্যায় বাংলাদেশে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
“বাংলা ভাষা” ভেসে যাচ্ছে। “বাংলা একাডেমি”- অর্ধেক বাংলা, অর্ধেক ইংরেজি।
“আওয়ামী রিগ”- অর্ধেক উর্দু, অর্ধেক ইংরেজি। বিএনপি- বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট
পার্টি- পুরো ইংরেজি। যুক্তফ্রন্ট- আধা আধা। “অক্সিজেন”, “ইউনিভার্সিটি”,
“রেডিও”, “টেলিভিশন”- বললে সবাই বুঝবে। “অম্লজান”, “বিশ্ববিদ্যালয়,”
“বেতার,” “দুরদর্শন” বললে অশিক্ষিতরা একেবারেই বুঝবেনা। যেমন ধরুন, যদি
রিকসা চালককে বলি, ও ভাই “অম্লযান” যাইবা? সে বুঝবেনা। যদি বলি, অক্সিজেন
যাইবা? সে বলবে, যাব। যদি বলি “ছায়াছবি দেখবা”? সে বলে বসবে, কি কইলেন? যদি
বলেন, সিনেমা দেখবা? সে বলবে, দেখব। আমরা “লিংগুয়া ফ্রাংকার” কবলে পড়েছি।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের “একুশের চেতনার” বিবর্তন নিয়ে ভাবতে হবে। একুশের
চেতনা- এক যায়গায় স্থির বসে নেই। আছে কি? চেতনার মুল জিনিস ঠিক থাকে। তাকে
ধারন করার “কন্টেইনারকে” শান দিতে হয়। শানিত করতে হয়।
একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারের বেদীতে আমরা ফুল দিই। প্রভাত ফেরি করি।
খালি পায়ে থাকি। সাদা পাঞ্জাবী পরিধান করি। কালো ব্যাজ লাগাই। (সেলফি তোলা,
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কথা বললাম না।) তো, এসব করলে মাতৃভাষাকে মর্যাদা
দেয়া হয়ে যায়? শুদ্ধ ভাবে ভাষার চর্চা, শিকেয় তুলে রাখবেন? সর্বস্তরে ভাষার
ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবেনা?
আমার স্যার চিত্ত প্রসাদ তালুকদার কমার্স কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৪ সালে
আমি ওই কলেজে যোগদান করার পর মাঝে মাঝে স্যার রিকশায় উনার সাথে আমাকে
নিতেন। মোগলটুলির রাস্তায় যাওয়ার সময় স্যার দেখতেন, দোকানের সাইনবোর্ড,
রিকসা অটো, অন্য গাড়ির পেছনে বাংলা লেখায় বানান ভুল। যেমন, গাড়ির পেছনে
লিখেছে, “১০০ হত ধুরে তাকুন”। দোকানের সাইন বোর্ডে লেখা হয়েছে, “আলমর খজ।”
গাড়ির পেছনে লিখার কথা “১০০ হাত দূরে থাকুন”, দোকানে নাম ছিল, “আল মরকজ”।
স্যার গাড়িওয়ালাকে থামিয়ে বলতেন, বাবা, তোমার লেখাটা ভুল। দোকানদারকেও
বলতেন। ভাষা বিজ্ঞানী ছিলেন বলেই, স্যার, বানান ভুল দেখলে মন খারাপ করতেন।
এখন কি অবস্থা বদলেছে? ভাল থাকুন চিত্ত স্যার।
১৯৬৪/৬৫/৬৬ সালে পুর্ব পাকিস্তানে গুরুতর অবস্থা ছিল। এক সিংহ, এক বাঘ এবং
এক শিয়াল বনে একত্রে বাস করত। সিংহ তাদের রাজা। একদিন তিনজন মিলে একটি
মহিষ, একটি গরু ও একটি হরিণ শিকার করে। সিংহ- বাঘকে বলে, তুমি খাবার ভাগ
করে দাও। বাঘ বল্ল- আপনি বনের রাজা, মহিষ আপনার জন্য। আমি শক্তিধর বাঘ, গরু
আমার জন্য এবং হরিণ- শেয়ালের জন্য। সিংহ ঝট্ করে থাবা বসায় বাঘের ঘাড়ে।
বাঘ মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে। এবার শেয়ালকে বলে, তুমি খাবার ভাগ করে দাও।
শেয়াল বলে, বাবা, মহিষ আপনি এখন খাবেন। গরু খাবেন রাত্রে। হরিণ কাল সকালের
নাস্তায় খাবেন। সিংহ বলে, এত সুষম বন্টন ব্যবস্থা তুমি কার কাছে শিখেছ?
শেয়াল মাঠে ছটফট করা বাঘকে দেখিয়ে দেয়। ৬৪/৬৫ সালে আমরা সিংহের থাবার নীচে
ছিলাম। ১৯৬৬ সালে আমরা কিছু ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী মিছিল করে লালদিঘির মাঠে
যাই। ছাত্রলীগ নেতা ডাঃ শামসুদ্দিনের সভাপতিত্বে একুশ উপলক্ষে সভা করার
চেষ্টা করি। পুলিশ বাধা দেয়। আমরা মুসলিম হলে গিয়ে সভা করতে বাধ্য হই।
কমার্স কলেজের ভেতরে একটা শহীদ মিনার আছে। ওটা আমাদের নেতাদের বানানো। আবু
ছালেহ, মোখতার ভাই, আবুল কালাম আজাদ, শায়েস্তা খান স্যার, লোকমানুল মাহমুদ
সিরাজুল ইসলাম উনারা আমাদের মতো কর্মীদের নিয়ে রাত্রে ইট সিমেন্ট দিয়ে শহীদ
মিনার বানাতেন। সকালে পুলিশ ওটা গুড়িয়ে দিত। ভাষার চেতনায় সমৃদ্ধ না হলে,
আমরা কখনো স্বাধীনতা আনতে পারতামনা। এই রাষ্ট্রের কাছে তোমরা ঋণী। তোমরা
যারা নতুন প্রজন্মের মানুষ। তোমরা শিক্ষক হয়েছ, ডাক্তার হয়েছ, তোমরা নেতা
হয়েছ, এমপি হয়েছ, মন্ত্রী হয়েছ। তোমরা নতুন প্রজন্মকে এই রাষ্ট্র কি দেয়
নাই? শিক্ষা দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, উদ্যোক্তা হবার শক্তি দিয়েছে। কিন্তু
আমরা ষাটের দশকে এবং একাত্তরে আমাদের জীবন যৌবন বিলিয়ে দিয়েছি, (তখন আমাদের
স্বপ্নের ভেতরে থাকা) এই রাষ্ট্রের জন্য। এই রাষ্ট্রের কাছে আমাদের চাওয়ার
কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু এবং উনার সৈনিকদের কাছে এই রাষ্ট্র ঋণী। এই রাষ্ট্র
ঋণী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। শহীদদের কাছে। এই রাষ্ট্র ঋণী সম্ভ্রম হারানো
বোনদের কাছে। ঋনী একুশের কাছে।
ইংরেজি ভাষা বিশ্বের সব চাইতে পছন্দের “লিংগুয়া ফ্রাংকা।” লিংগুয়া ফ্রাংকার
অর্থ হলো, যখন দুটি দেশের দুটি ভিন্ন ভাষার মানুষকে একটি জানা ভাষার উপর
নির্ভর করতে হয়, মনের ভাব আদান প্রদান করতে হয়, তখন একটি কমন ভাষার দরকার
হয়। একজন বাঙালি একজন সোমালিয়ান এর সাথে কোন্ ভাষায় কথা বলবে? আজকাল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখবেন, ছোট শিশুদের বাংলা নয়, ইংরেজিতে বলা
সংলাপ, গল্প ছড়া কবিতা প্রায়ই আপলোড করাচ্ছেন, গর্বিত পিতা মাতা। আপনারা
হয়ত জানেন ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর আয়ূব খান ঠিক করেছিলেন, আরবি হবে
“লিংগুয়া ফ্রাংকা।” আর জিন্নাহ তো ৪৮ সালে বলেছে উর্দু শেল বি দি স্টেট
ল্যাংগুয়েজ অফ পাকিস্তান। আমি স্কুলে আরবি ও উর্দু পড়েছি। আমি এই সাবজেক্ট
জানি। আপনারা আমার লেখা পড়ে বুঝতে পারেন। আমার বাংলা ছিলনা “ইজি ব্যাংগলি”
ছিল। সে জন্য আমি বাংলার জন্য থার্ষ্টি। আরবি অক্ষরে বাংলা আমরা লিখি নাই।
আমাদের বন্ধু ইনামুল হক দানু গভর্নর মোনায়েম খাঁকে জুতা মেরে দিয়েছিল।
কিন্তু এখন আপনারা ইংরেজি হরফে বাংলা লিখে যাচ্ছেন। এখন কেন লিখছেন? আমরা
যদি উর্দু ফার্স্ট ল্যাংগুয়েজ এর কাছে নতি স্বীকার করতাম, আরবি “লিংগুয়া
ফাংকার” কাছে বিলীন হয়ে যেতাম আপনারা আজ এই রাষ্ট্র পেতেন? আজ আপনার ভাষা
কি হতো? “মিন্ হাইয়েল বেলাদিল জিদ্? কাইফা হালুকা? ছাতুখোরদের পোন্দে
লাথি মেরেছি- আমরা সে প্রজন্ম। শক্তিধর গভর্নরকে জুতা মারা প্রজন্ম আমরা।
আল্লাহ বেহেশত নসীব কর দানু ভাইকে।
২০১০ সালের দিকের কথা। আমি গরীব বাচ্চাদের জন্য একটি প্রাথমিক স্কুল
দেখাশুনা করতাম। একদিন এক তরুণী এসে আমাকে বলে, স্যার, আমার মেয়ে আপনার
স্কুলে পড়ে- তাকে নিয়ে যাব। আমি বলি, কেন নিবা? এখানে এত ভাল লেখাপড়া হয়।
এই দেখতো আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার বানিয়েছে, বিভিন্ন উপকরণ
দিয়ে স্মৃতি সৌধ বানিয়েছে। বাচ্চা অন্য স্কুলে নেবে কেন? সে বলে, ওসব
বেদরকারি। শহীদ মিনার ধুইয়া পানি খাব নাকি? আমি বলি, তোমার বাড়ি কোথায়? সে
বলে, আমি আপনাদের এলাকার মেয়ে। আমার স্বামী বাজারে মাছ কাটে। বাসা এসি
মসজিদের ওদিকে। আমি বলি, তুমি কি চাও? সে বলে, আমার বাসায় মেহমান আসলে আমার
সরম লাগে। আমি বলি, কেন? সে বলে, আমার মাইয়া মেহমানের সামনে “টকিন” করেনা।
এখানে আরো স্কুল আছে ওরা “টকিন” করাতে পারে। আমার বাচ্চা “বিবি গ্রামার
স্কুলে” পড়াব। আমার শিক্ষকরা মেয়েটিকে বোঝাচ্ছিল। আমি তাদের থামালাম।
বল্লাম, এক সপ্তাহ পর দেখা করিও। “টকিন” (ইংলিশ টকিং) শেখাব। শিক্ষকরা
অবাক। কি ভাবে শেখাবেন? কয়েকদিন ধরে বাচ্চাকে শেখানো হল, কাউকে দেখলে বলবা,
“গুড মর্নিং।” চলে যাওয়ার সময় বলবা, “টা টা, গুড বাই।” কারো সাথে কথা বলার
সময় ঘন ঘন বলবা, “গুড”। ওরা হাসলে বলবা, “ফাইন” “নাইস”- ইত্যাদি। এক
সপ্তাহ পর সেই মাছ কাটাওয়ালার বৌ এসে বল্ল, স্যার, মেহমানগন খুশী। মেয়ে
“টকিন” করতে পারে। হে মহান একুশ, আমাকে ক্ষমা কর। আমরা তোমাকে এই দিনে
শ্রদ্ধা জানাই। বাকী সারা বছর বাচ্চাদের “টকিন” শেখাই। আর ফেসবুকে- “ঐড় িজ
ট” মার্কা স্ট্যাটাস দিই। একুশের চেতনা হারিয়ে গেলে তুমি আমি হারিয়ে যাব।
সবাই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করুন।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
| M | T | W | T | F | S | S |
|---|---|---|---|---|---|---|
| 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 |
| 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 |
| 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 |
| 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 |
| 29 | 30 | 31 | ||||
