চিটাগাং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন সার্জারি (সিআরআইসিএস) নগরীর নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সমপ্রতি একটি জরিপ পরিচালনা করেছে । স্কুলটির ১ হাজার ৩১৫ জন ছাত্রীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি। রক্তের নমুনাসহ সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত। তবে চোখ কপালে ওঠার মতো তথ্য মিলেছে ছাত্রীদের চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। জরিপের আওতায় আনা মোট ১ হাজার ৩১৫ জন ছাত্রীর মধ্যে ৬০৮ জনই চোখের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসেবে এই হার ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি একশ জনে ৪৬ জন ছাত্রী চোখের বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত। আক্রান্তদের অধিকাংশই (৯০ শতাংশের বেশি) মায়োপিয়া রোগের শিকার। এটি চোখের অন্যতম একটি রোগ। চক্ষু চিকিৎসকরা বলছেন- কাছের বস্তু ঠিকমতো দেখতে পেলেও এ রোগে আক্রান্তরা দূরের বস্তু ঠিকমতো দেখতে পান না, ঝাপসা দেখেন। চিকিৎসকদের মতে- চোখের প্রতিসারক ক্রুটির জন্য মায়োপিয়া হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় দূরের কোন বস্তুর ফোকাস রেটিনার উপর পড়ে। কিন্তু মায়োপিয়া হলে এ ফোকাস রেটিনার সামনে পড়ে। ফলে দূরের বস্তুকে অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে দেখায়। তাই চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং মাথাব্যথা দেখা দেয়। এটি যন্ত্রণাদায়ক একটি সমস্যা। এ রোগের চিকিৎসা করা না হলে চোখের রেটিনা ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
আর দীর্ঘ সময় ধরে স্মার্ট ফোন-কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা এবং টিভি দেখা এ রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে বলছেন পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট মর্তুজা নূরউদ্দিন। অন্যান্য কারণের মধ্যে কোন কাজ করার সময় খুব কাছ থেকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা, অন্ধকারে বা কম আলোতে কাজ করা, দীর্ঘদিন মাইনাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার এবং বংশগত কারণেও মায়োপিয়া হতে পারে বলে বলছেন চিকিৎসকরা।
উক্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়- স্কুলটির ১ হাজার ৩১৫ ছাত্রীর মধ্যে ৬০৮ জনই আক্রান্ত চোখের অসুখে। এর মধ্যে ৫৪৯ জন ছাত্রী মায়োপিয়ায় আক্রান্ত। এটি মোট আক্রান্তের ৯০ শতাংশেরও বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্কুইন্ট বা ট্যারা রোগ। স্কুলটির ১৬ জন ছাত্রী এ রোগে আক্রান্ত। আর ১২ জন ছাত্রী চোখের হাইপারমেট্রোপিয়া রোগে আক্রান্ত। এটি মায়োপিয়া রোগের বিপরীত একটি রোগ। হাইপারমেট্রোপিয়া রোগে আক্রান্তরা কাছের বস্তু ঠিকমতো দেখতে পান না। অস্পষ্ট দেখেন। এছাড়া ১০ জন ছাত্রী এঙেসেসিভ টিয়ার সিক্রেশন বা চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে, এমন রোগে আক্রান্ত। এর বাইরে চোখ লাল হওয়া, চুলকানো, ঝাপসা দেখা, চোখ ব্যথা, জন্মগত ক্রুটিসহ ছাত্রীদের চোখে আরো বেশ কয়টি রোগে আক্রান্তের তথ্য রয়েছে প্রতিবেদনে।
সিআরআইসিএস সূত্রে জানা গেছে- ২০১৮ সালে দুই দফায় স্কুলটির ৫ম থেকে ৯ম শ্রেণির ছাত্রীদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন স্ক্রিনিং করা হয়। প্রথম দফায় ৩১ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল মর্নিং শিফটের ছাত্রীদের স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ডে-শিফটের ছাত্রীদের স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ সেপ্টেম্বর। প্রথম দফায় মোট দশ দিন এবং দ্বিতীয় দফায় মোট ৫ দিন এ কার্যক্রম চালানো হয়। এতে সহযোগিতায় ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন ডাক্তাররা। একই সময় সন্ধানী, চমেক শাখার উদ্যোগে ছাত্রীদের রক্তের গ্রুপও নির্ণয় করা হয়। প্রাথমিক স্ক্রিনিং ও রোগ শনাক্তের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ছিলেন সিআরআইসিএস-এর পরিচালক শিশু সার্জন প্রফেসর ডা. তাহমিনা বানু, গাইনোকোলজিস্ট প্রফেসর ডা. রোকেয়া বেগম, শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাশেদা সামাদ, চর্ম রোগের চিকিৎসক ডা. মুর্শিদ আরা বেগম, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল মান্নান সিকদার।
স্কুল হেলথ স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের আওতায় এই জরিপ চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয় জানিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শিশু সার্জন প্রফেসর ডা. তাহমিনা বানু বলেন- চট্টগ্রামে এরকম উদ্যোগ এটিই প্রথম। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে গবেষণা তেমন একটা হয় না বললেই চলে। কিন্তু রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে রোগের প্রকৃত কারণ বের করতে গবেষণাই স্বীকৃত পন্থা। আমরা সিআরআইসিএস-এর পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়টি জরিপ/গবেষণা কার্যক্রম শেষ করেছি। স্কুল হেলথ স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের আওতায় ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েই প্রথম এই স্ক্রিনিং ও জরিপ চালানো হয়েছে। পরে বালকদের একটি স্কুলে এ কার্যক্রম চালানো হবে বলেও জানান তিনি।
স্ক্রিনিংয়ে পাওয়া ছাত্রীদের চোখের অসুখের চিত্র ভয়াবহ বলে মনে করেন প্রফেসর ডা. তাহমিনা বানু। তিনি মনে করেন- স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার টানা ব্যবহার এবং দীর্ঘ সময় ধরে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণেই ছাত্রীদের চোখে এ রকম অসুখ বাসা বাঁধছে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। চোখের সমস্যা ছাড়াও স্কুলটির ছাত্রীদের মাঝে এলার্জি, পেটের অসুখ, প্রস্রাবে সমস্যা, পুষ্টিহীনতা ও ঠান্ডাজনিত রোগ ধরা পড়েছে বলেও জানান ডা. তাহমিনা বানু।
শিক্ষার্থীদের মায়োপিয়া আক্রান্তের বিষয়ে ডা. মর্তুজা নূরউদ্দিন বলেন- ছাত্রছাত্রীদের মাঝে এখন স্মার্ট ফোন, ট্যাব ও ল্যাপটপ-কম্পিউটার ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। আছে টিভি দেখার প্রবণতাও। একটানা বা বেশি সময় ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে এ রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। আগে চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা তেমন করা হতো না বলে রোগের বিষয়ে জানা যেত না। এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, ফলে রোগের বিষয়টি ধরা পড়ে। চোখের সুরক্ষায় ভিজ্যুয়াল এসব ডিভাইস থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালের এই সিনিয়র কনসালটেন্ট।
বিষয়টি অস্বীকার করেননি ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহিদা আক্তার। তিনি বলছেন- যদিও স্কুলে থাকাকালীন ছাত্রীরা এসব ব্যবহারের সুযোগ পায় না। কিন্তু স্কুল এবং শিক্ষকের সামনে থাকা সময় বাদ দিলে বাকি সময়ের বেশির ভাগই ছাত্রীরা এসব ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে। মোটকথা, যতক্ষণ পড়ার মধ্যে থাকে ততক্ষণ। এর বাইরে গেলেই হাতে ফোন, নয়তো ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার। টিভিও তো আছেই। প্রায়ই অভিভাবক আমাদের এ অভিযোগ করে থাকেন।
খেলাধুলার চেয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব ডিভাইসে বেশি আগ্রহ উল্লেখ করে প্রধান শিক্ষিকা বলেন- আগে হয়তো টিভি নিয়ে পড়ে থাকতো। এখন স্মার্ট ফোনে গেম খেলতেই বেশি আগ্রহ তাদের। ফেসবুক তো আছেই। এবয়সে ছেলে-মেয়েদের হাতে বেশি সময় ধরে এসব ইলেকট্রনিকস ডিভাইস তুলে না দেয়ার অনুরোধ জানান প্রধান শিক্ষিকা শাহিদা আক্তার।
এদিকে, ডায়েরি অপথেলমোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সালে ৪.৮ বিলিয়ন মানুষ (যা এই পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার সমান) মায়োপিয়া বা দৃষ্টিক্ষীণতার সমস্যায় পীড়িত হবেন। ২০০০ সাল থেকে এ সমস্যাটি বেড়ে চলেছে। আক্রান্তদের প্রতি ১০ জনে ১ জন অন্ধত্বের ঝুঁকির মধ্যে আছেন বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
বর্তমানে মানুষ বেশিরভাগ সময় ঘরের ভিতরে টিভির সামনে, কম্পিউটারের সামনে এবং সেলফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সময় কাটায় বলেই চোখের সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
এ রোগ (মায়োপিয়া) থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে শিশুদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো, প্রয়োজন ছাড়া ফোন ব্যবহার না করা, দিগন্তের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
| M | T | W | T | F | S | S |
|---|---|---|---|---|---|---|
| 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 |
| 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 |
| 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 |
| 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 |
| 29 | 30 | 31 | ||||
