অর্থমন্ত্রী প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘোষণা করেছেন , যেখানে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে এর বাইরে অভিনবত্ব বা তেমন চমক নেই। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নতুন যেসব প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়েও আগে থেকেই কথা হচ্ছে।

তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার এই বাজেট পেশ করেন জাতীয় সংসদে। তবে তিনি বক্তব্য শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি অসুস্থতার কারণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষ করেছেন বক্তব্য।

এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রেখে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার এই বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ দুই হাজার কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দিয়েছেন। ১১ বছরে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। যুবকদের ব্যবসায়ী হিসেবেও গড়ে তোলার কথা জানিয়েছেন তিনি। এ ব্যপারে যুবকদের ব্যবসা শুরুর জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণের আওতাও বাড়ানো হবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা বিনিয়োগের সুবিধাও রেখেছেন। এর ফলেও নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

শিক্ষিত বেকারদেরকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে ঋণ দেয়ার জন্য বিশেষ তহবিল গঠন, নারী উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা, প্রবাসীদের জন্য বিমা চালু করা, তৈরি পোশাক শিল্পে বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ‘গ্রামে শহরের সুবিধা’ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে বাজেটে। গ্রামের অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামের হাট বাজারগুলোকে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হিসাবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়াও গ্রামের মানুষের কাছাকাছি প্রশাসনিক ক্ষমতা পৌঁছে দেওয়া, ব্যাংকিং সুবিধার প্রসারের জন্য বাজেটে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এবারের বাজেটে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে ভ্যাটের আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। তবে কিছু খাতে ভ্যাটের হার কমানো হয়েছে। এক স্তরের পরিবর্তে পাঁচ স্তরে ভ্যাট আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

দুই বছর আগেই নতুন ভ্যাট আইন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোটের কথা বিবেচনায় নিয়ে তা স্থগিত করা হয়। ওই সময়ে ব্যবসায়ীরা দুই বছর পর ভ্যাট আরোপের সিন্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

গত টানা চার বছর ধরে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়েনি। এবারও বাড়ানো হয়নি। ফলে অনেক ব্যক্তি করজালে ঢুকে পড়ছেন। এভাবে ভ্যাট ও করের জাল বাড়ানো হয়েছে।

গত দুই দিন ধরেই অর্থমন্ত্রী ছিলেন অসুস্থ। বাজেটের সকালে তিনি হাসপাতাল থেকেই আসেন সংসদে। অধিবেশন শুরুর আগে সংসদের কেবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপর অর্থমন্ত্রী তার বিখ্যাত ব্রিফকেস হাতে প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গে নিযে যান অধিবেশনে।

অর্থমন্ত্রীর পরনে ছিল অফহোয়াইট কালারের পাঞ্জাবির ওপর কালো রংয়ের মুজিব কোট। প্রধানমন্ত্রী পরনে ছিল তাতের শাড়ি ও স্পিকারের পরনে ছিল লাল ও সাদার মিশ্রনে তৈরি জামদানি শাড়ি।

বৈধপথে রেমিটেন্স আনার জন্য আগামী অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা রাখা হচ্ছে। এজন্য আগামী অর্থবছরের জন্য তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেটে বেশ কিছু সংস্কারের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সঞ্চয়পত্র কেনা-বেচা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র ক্রয় নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ইএফটির মাধ্যমে পেনশন প্রদানের উদ্যোগের কথাও জানান অর্থমন্ত্রী। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের গ্রুপ বিমার আওতায় আনতে সমন্বিত বিমা ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে শিগগির ইউনিভার্সেল পেনশন অথরিটি গঠন করা হবে।

করপোরেট করহার বাড়েওনি কমেওনি। পুঁজিবাজারে করমুক্ত লভ্যাংশ ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এছাড়া বোনাস শেয়ার এবং রিজার্ভ ৫০ শতাংশের বেশি হলে ১৫ শতাংশ নতুন করে কর আরোপ করা হয়েছে।

আয় ব্যয় কতো

আগামী এক বছর সরকার উন্নয়ন ও পরিচালন খাতে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ব্যয় করবে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মূল বাজেট ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এই হিসাবে বাজেট বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি।

বড় আকারের ব্যয় মেটাতে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ আয় হবে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১৩ দশমিক ১ শতাংশের সমান।

চলতি বছর মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এনবিআর তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করবে, যা মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। এনবিআরবহির্ভূত কর রাজস্ব পরিমাণ ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। কর ব্যতীত আয় হবে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ আগামী বছরে দাঁড়াবে চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।

উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ

প্রস্তাবিত বাজেটের দুই পঞ্চমাংশ ব্যয় হবে উন্নয়নে। অর্থমন্ত্রী এই খাতে বরাদ্দ রেকেছেন দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন এডিপিতে মোট প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৫৬৪টি। এরমধ্যে কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১১৬টি, জেডিসিএফ প্রকল্প একটি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব প্রকল্প রয়েছে ৮৯টি ও বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৩৫৮টি।

অসমাপ্ত প্রকল্প শেষ করার জন্য নির্ধারিত প্রকল্প ধরা হয়েছে ৩৫৫টি। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) প্রকল্প ৬২টি।

এবারের এডিপিতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পরিবহণ ও শিক্ষা খাতকে।

ঘাটতি

বিশাল আকারের বাজেটে বাড়বে ঘাটতিও। সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এটা জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। এই ঘাটতি পূরণে সরকার নির্ভর করবে ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র এবং বিদেশি ঋণের ওপর।

কমিয়ে আনা হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা। এতে সরকারকে ঋণের সুদ পরিশোধে কম টাকা গুনতে হবে।

ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীন উৎসব থেকে ঋণ নেওয়া হবে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক উৎস থেকে পাওয়ার আশা করা হচ্ছে প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031