মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এসব বস্তির তালিকা ও মানচিত্র তৈরি করে একাধিকবার সাঁড়াশি অভিযান চালানো হলেও কোনো সুফল মিলছে না। চট্টগ্রামের বস্তিগুলো দিন দিন যেন একেকটা ‘ক্রাইম জোন’ হয়ে উঠছে। প্রতিটি অভিযানের সংবাদ আগেই যেন পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা।
আইন-শৃক্সখলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, চুরি, ছিনতাই কিংবা ডাকাতি পেশায় জড়িতদের একটি বড় অংশ বস্তিবাসী। এছাড়া চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িতদের আত্মগোপনে থাকার নির্ভরযোগ্য স্থানও এসব বস্তি। নগরের এসব বস্তি ঘিরেই চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। এখানকার অপরাধীরা এতটাই বেপরোয়া যে, এসব বস্তিতে অভিযান চালাতে গিয়ে আইনশৃক্সখলা বাহিনী একাধিকবার হামলার শিকারও হয়েছে। অভিযোগ আছে, প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার কারণে বস্তি কেন্দ্রিক এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মো. মোস্তাইন হোসেন আজাদীকে বলেন, নগরের বিভিন্ন বস্তিকে কেন্দ্র করে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য সব সময় ছিল। বিভিন্ন সময় আমরা অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তারও করেছি। এটি চলমান প্রক্রিয়া। কমিশনার স্যার সকল ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী আমরা সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করছি। চট্টগ্রামের বস্তিগুলো মাদকের রমরমা হাট স্বীকার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, বস্তি কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা বন্ধে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। ক্রমান্বয়ে এ অভিযান আরো জোরদার হবে।
সমপ্রতি এক জরিপে বলা হয়েছে, কাজের সন্ধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও উচ্ছেদসহ নানা কারণে দিন দিন নগরে বস্তিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। এরা মানবপাচার, যৌন হয়রানি, বাল্য বিবাহ ও মাদকসহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এদের দারিদ্র্যতা ও অশিক্ষাকে পুঁজি করে বিভিন্ন সিন্ডিকেট তাদের ব্যবহার করছে।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নগরের যেসব বস্তিতে মাদকের বেচাকেনা হয় তার তালিকা তৈরি করেছে আইনশৃক্সখলা বাহিনী। একই সঙ্গে এসব বেচাকেনায় কারা জড়িত তাদেরও তালিকা করা হয়েছে। তালিকানুযায়ী, নগরে গড়ে ওঠা অবৈধ ৫০টি বস্তিতে মাদক ব্যবসা চলছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এসব মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে তাদের এই ব্যবসা। এসব বস্তিতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য বিকিকিনি হচ্ছে। বস্তি কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা এসব মাদকের আখড়ায় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল ও চোলাইমদসহ হরেক রকম মাদক বিক্রি ও সেবনের পাশাপাশি বাড়ছে অপরাধও। স্থানীয় সন্ত্রাসীরা এসব নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, নগরে অপরাধের স্বর্গরাজ্য খ্যাত বরিশাল কলোনির বিশাল বস্তি এবং তার পাশে ধোপার মাঠে গড়ে ওঠা বস্তি দুটি উচ্ছেদের পর ওখানকার অপরাধীরা ছড়িয়ে পড়েছে নগর জুড়ে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় তারা নতুন করে আস্তানা গড়ে তুলেছে। কদমতলী ও মাদারবাড়ির প্রায় ত্রিশ একর রেলের জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল বরিশাল কলোনিটি। এছাড়া বিআরটিসি এলাকার রেলওয়ে চৌদ্দ জামতলা বস্তি, গোয়ালপাড়ায় তুলাতুলি বস্তি, রেলওয়ের দেওয়ানহাট বস্তি, মনসুরাবাদ রেলওয়ে কলোনি, ঝর্ণাপাড়া ঢেবারপাড় বস্তি, পাহাড়তলী রেলস্টেশন কলোনি ও পাহাড়তলী স্ক্যাপ ডিপো মাদকসহ নানাবিধ অপরাধের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত।
দীর্ঘদিন ধরে নগরীর পুরাতন রেলস্টেশন থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত রেল লাইনের দু’পাশে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে। এর মধ্যে টাইগারপাস, আমবাগান, ঝাউতলা, কর্ণফুলী মার্কেটের আশপাশের এলাকা, দুই নম্বর গেট, আমিন জুট মিল্‌স, রৌফাবাদ ও অক্সিজেন এলাকায় রেল লাইনের দু’পাশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বস্তি। অবৈধ এসব বস্তি নগরের ক্রাইম জোন হিসেবে পরিচিত। কিছুদিন আগে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সময় বেঁধে দিয়ে অভিযান চালানো হলেও পরবর্তীতে সেগুলো আবার পুনর্দখল হয়ে যায়। রেল কর্তৃপক্ষ বার বার স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা যোগসাজসে সেগুলো আবারও তৈরি করা হয়। প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাসোহরার বিনিময়ে রেল লাইনের পাশের এসব স্থাপনায় নিম্নআয়ের মানুষজন বসবাস করছে। বস্তিতে অনেকেই আছেন যাদের মূল পেশাই হলো মিছিলে বা প্রোগ্রামে লোক সরবরাহ করা।
নগরের মতিঝর্ণার জিলাপির পাহাড়, টাঙ্কির পাহাড়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাহাড় ও বাটালি পাহাড়ের পাদদেশেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য বস্তি। উত্তর দিকে টাঙ্কির পাহাড়, এ কে খানের পাহাড় হয়ে দক্ষিণ দিকে জিলাপির পাহাড়, বাটালি পাহাড় হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে টাইগার পাস রেলওয়ে কলোনি পর্যন্ত প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এসব বস্তি। মতিঝর্ণার পাশাপাশি বাঘঘোনা এলাকার মুছার পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়ে উঠেছে। এছাড়াও ফয়’স লেক, কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা, দক্ষিণ পাহাড়তলির সেকান্দরপাড়া, কাইচ্যাঘোনা, লেবুবাগান প্রভৃতি এলাকায় গড়ে উঠা বস্তিতে থাকা মানুষ জীবিকার তাগিদে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে একাধিক বস্তি অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ডাকাতি, ছিনতাই ও গাড়ি চুরিসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িতরা অপরাধ করে এসব বস্তিতে আশ্রয় গ্রহণ করছে।
এদিকে জেলা গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ধরে সীতাকুণ্ড জঙ্গল ছলিমপুর এলাকার ছিন্নমূল বস্তি ঘিরে আরেকটি ক্রাইম জোন গড়ে উঠেছে। এখানকার সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু ও চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এখানে প্রায়ই সংঘর্ষ চলে। এছাড়া বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ছাড়াও এখানে ঘটেছে একাধিক ধর্ষণের ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, নগর ও জেলার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ করে দুর্বৃত্তরা সহজেই এখানে আত্মগোপন করে থাকে। এছাড়া এখানকার সন্ত্রাসীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতি, পণ্যবোঝাই কাভার্ডভ্যান ছিনতাই, গণছিনতাই ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাটসহ ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড ও মীরসরাইয়ে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। নগরের অলঙ্কার মোড়, কর্নেলহাট, বিশ্বকলোনি, ছিন্নমূল বস্তি, খুলশী, শেরশাহ কলোনি, আমিন কলোনি, শান্তি নগর, মোহাম্মদ নগর, বার্মা কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি ও অক্সিজেন শহীদ নগরে তাদের রয়েছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। নগর ও আশেপাশে অপরাধ করে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সুবিধা থাকায় তারা জঙ্গল ছলিমপুর এলাকাকে বেছে নিয়েছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031