প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রিয়া সাহা কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন, সেই ব্যাখ্যা না শুনে তড়িঘড়ি কোনো আইনি ব্যবস্থায় না যেতে । গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের সময়বদ্ধ পরিকল্পনার ব্রান্ডিং বিষয়ক সেমিনার শেষে তিনি একথা বলেন।
কাদের বলেন, দেশের বাইরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে এ ধরনের বক্তব্য (তিনি) কেন দিয়েছেন, সেটা দেশে ফিরে এলে আমার মনে হয় তারও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা উচিত। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের লিডার, গতরাতে আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন, সেটা হচ্ছে- এখানে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রিয়া সাহা যা বলেছেন, ‘শি শুড মেইক এ পাবলিক স্টেটমেন্ট’। খবর বিডিনিউজের।
তিনি আসলে কি বলেছেন, কি বলতে চেয়েছেন তার একটি পাবলিক স্টেটমেন্ট করা উচিত, তারও আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ থাকা উচিত। তার আগে কোনো প্রকার মামলা বা আইনি প্রক্রিয়া শুরু না করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারপ্রধানের এ নির্দেশনার কথা জানানোর আগেই গতকাল রোববার সকালে ঢাকার হাকিম আদালতে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দুটি মামলার আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জেলার আদালতেও অভিযোগ করা হচ্ছে। তবে সরকারের অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা যায় না স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এসব মামলা গ্রহণ করা হবে না। অভিযোগের বিষয়ে প্রিয়া সাহার বক্তব্য জানার আগে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না।
এবিষয়ে কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে মানা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আজ (গতকাল) একটা মামলা করার কথা ছিল, তাকে আমি জানিয়েছি এ ধরনের মামলার প্রসিডিং শুরু না করতে এবং আইনমন্ত্রীর সাথেও এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। এছাড়া প্রিয়া সাহার ব্যক্তিগত বাড়িঘর সম্পদ, সেখানে যাতে প্রটেকিটিভ মেজার থাকে, যথার্থ নিরাপত্তা থাকে সে স্টেপ নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মেসেজ জানিয়ে দিয়েছি।
গতকাল রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠকের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আমার বক্তব্য শুনেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমি তাকে বলেছি, হি ইজ ভেরি হ্যাপি আমার মনে হয়, হি ইজ ভেরি স্যাটিসফায়েড। আমাদের ভাবনার সাথে পজিটিভলি রেসপন্স করেছে দেখেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রিয়া সাহার দেশে ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে তার দেশে আসবে না কেন। এখানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের রানা দাসগুপ্তের সাথে কথা হয়েছে। এই বক্তব্য তার ব্যক্তিগত কমেন্ট, এর সাথে পরিষদের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের আসার অধিকার তার আছে, দেশে আসার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছি না বা কোনো লিগ্যাল প্রসিডিউরও শুরু করছি না।
দেশে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যেগ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয় তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশে আসতে পারেন, সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া বা বাধা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগ করার পেছনে কোনো মদদ আছে কিনা জানতে চাইলে কাদের বলেন, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, উসকানিমূলক এবং অসত্য, কাল্পনিক বক্তব্য। তিনি কেন দিলেন, আমরা তার কাছে জানতে চাইব, তিনি দেশে ফিরে আসুক তার কাছে জানতে চাইব, উদ্দেশ্য কি, মোটিভটা কি।এটা তো তার থেকে আমাদের পাবলিক স্টেটমেন্টটা জানা উচিত, আসার পরই কোন স্টেপ নেয়ার বিষয়ে ভাবা যাবে। এর পেছনে কারা রয়েছে এবিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য আছে কিনা জানতে চাইলে কাদের বলেন, এ মুহূর্তে আমরা এখনো সবকিছু পরিষ্কার না।
দুই আবেদন খারিজ : ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করায় প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার দুটি আবেদনই আদালত খারিজ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতি না থাকায় মামলার আবেদন দুটি রোববার খারিজ করে দেন ঢাকার দুইজন মহানগর হাকিম।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়্যেদুল হক সুমন এবং ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ইব্রাহিম খলিল গতকাল সকালে ঢাকার হাকিম আদালতে মামলা করার ওই দুটি আবেদন করেন।
সুমনের আবেদনের শুনানি হয় ঢাকার মহানগর হাকিম জিয়াউল হাসানের আদালতে। আর ঢাকার মহানগর হাকিম আবু সুফিয়ান মো. নোমান শোনেন খলিলের মামলার আরজি। দণ্ডবিধির ১২৩ (এ), ১২৪ (এ) ও ৫০০ ধারায় দায়ের করা এসব আবেদনে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও চাওয়া হয়। তবে শুনানি শেষে দুই আবেদনই খারিজ হয়ে যায়।
প্রিয়ার যুক্তরাষ্ট্রে গমন তদন্ত করা উচিত : প্রিয়া সাহা কীভাবে এবং কাদের প্রতিনিধি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন তা তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। একই সঙ্গে ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের যে অভিযোগ করেছেন তাতে তার দুদক কর্মকর্তা স্বামীর প্ররোচনা আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মত দিয়েছেন তিনি। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গতকাল রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এসব কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী। তাকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছে তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবেন কিনা- এই প্রশ্নে হাছান মাহমুদ বলেন, অবশ্যই সেটি খোঁজ-খবর নেওয়ার বিষয়, খোঁজ-খবর নেওয়ার দাবি রাখে। কারণ তিনি কীভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হলেন? যেখানে তার এই বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্ত সংখ্যালঘুরা দ্বিমত পোষণ করছে, তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে, তিনি কীভাবে কাদের প্রতিনিধি হলেন সেটি অবশ্যই তদন্তের বিষয়।
প্রিয়া সাহার কথার সঙ্গে মামলার মিল নেই : গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, প্রিয়া সাহার বাবার বাড়ি ও তার নিজের বাড়ি একই ইউনিয়নে। তার এলাকায় এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, প্রিয় বালা বিশ্বাসের ভাই জগদীশ বিশ্বাস অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা; তিনি বাড়িতে থাকেন না। এক রাতে তার বাড়ির পরিত্যক্ত একটি ঘরে আগুন লাগে এবং সেই ঘটনায় বাড়ির কেয়ারটেকার কমলেশ বিশ্বাস বাদী হয়ে থানায় মামলা করে। মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা করা হয়নি এবং কাউকে সন্দেহও করা হয়নি। এজাহারে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি নষ্ট করার জন্য কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠী বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে, এমন শঙ্কার কথা এজাহারে তিনি বলেননি।
রেজাউল বলেন, কমলেশ বিশ্বাস এ বছরের ২৯ এপ্রিল নাজিরপুর থানায় আরেকটি মামলা করেছেন। তবে ওই ঘটনা কোনো সামপ্রদায়িক হামলার নয়। এটা মারামারির মামলা। আসামিদের মধ্যে হিন্দুও ছিল।
অভিযোগের পেছনে ‘প্ররোচনা’ দেখছেন পীযূষ : প্রিয়া সাহার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগের পেছনে প্ররোচনা রয়েছে বলে মনে করছেন ‘সমপ্রীতি বাংলাদেশ’-এর আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। গতকাল রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রিয়ার বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন তিনি। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, একটি সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি আবারও এদেশের সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি নষ্ট করার হীন চেষ্টায় রত। ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার করা অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার ‘কোনো মিল নেই’ দাবি করে তিনি বলেন, ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এমন কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। তার এই অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করার দাবি জানিয়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, প্রিয়া সাহা কারও প্ররোচনায় বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই মিথ্যাচার করেছেন, সে বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্তেরও দাবি জানাই।