মৃতদের সৎকারে কঠোর সাবধানতা মানা হচ্ছে প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কভিড-১৯ এ । নতুন এই ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ার কারণেই এই ব্যবস্থা। তিন বছর আগে ইবোলা ভাইরাসে মৃতদের সৎকারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যে প্রটোকল নির্ধারণ করেছিল সেটাকেই সামনে রেখে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর কভিড-১৯ এ মৃতদের সৎকারের প্রক্রিয়া ঠিক করেছে, যেখানে সব ধর্মেরই বিধান মানা হবে।
বাংলাদেশে শনিবার পর্যন্ত ২৪ জনের কভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের খবর দিয়েছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে গত বুধবার একজন এবং শনিবার দ্বিতীয়জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীতে এই ভাইরাসে মৃতদের খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে দাফনের সিদ্ধান্ত হলেও তার আগেই প্রথম মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে আইইডিসিআরের তত্ত্বাবধানে।
আইইডিসিআর থেকে জানা গেছে, মৃত ওই ব্যক্তির গোসল থেকে শুরু করে কবরস্থানে নিয়ে দাফন-পুরোটাই হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। দাফনের সময় তার পরিবারের লোকজনও কবরস্থানে ছিলেন না বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের একজন কর্মকর্তা। তবে কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার দাফনে অংশ নিতে কোনো সমস্যা নেই বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গবেষক মুশতাকের অভিজ্ঞতা সরকারও কাজে লাগাচ্ছে।
ডা. মুশতাক বিডিনিউজকে বলেন, কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির সৎকার কীভাবে হবে, সে বিষয়ে এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো প্রটোকল নেই। তবে ২০১৭ সালে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্তদের মরদেহ সৎকারে ডব্লিউএইচওর তৈরি নিয়ম মেনে আইইডিসিআর একটা প্রটোকল তৈরি করেছে। এখানে ধর্মীয় সব বিধান মেনে চলা হয়। ‘সে সময় ডব্লিউএইচও যে প্রটোকল করেছিল সেটাকে কিছুটা মোডিফাই করে একটা প্রটোকল তৈরি করেছি। তবে ইবোলায় মৃতদের দাফন-কাফনের নিয়ম আরেকটু কঠোর ছিল। ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির নাকমুখ দিয়ে ফ্লুইডটা বের হয়ে ছড়াতে পারে। তবে সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করিয়ে নিয়ে জীবাণু অনেকটাই মরে যায়।’ কভিড-১৯ এ মৃতের দাফনের প্রক্রিয়া কী জানতে চাইলে এই ভাইরোলজিস্ট জানান, যে হাসপাতালে মারা গেছেন সেখানেই প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে গোসল করানো হয়। পুরো কাজটি করা হয় খুব সাবধানতার সঙ্গে। গোসল করানোর কাজটি একজন বা দুজন করবেন। যিনি গোসল করাবেন তিনি নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ‘ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ বা পিপিই’ যেমন মাস্ক, গ্লাভস ও বিশেষ ধরনের পোশাক পরে নেবেন। এ গোসল সাবান দিয়েই করানো হয়। সাবান দিয়ে পুরো শরীর ধুয়ে দেবেন। সাবান যত ক্ষারযুক্ত হয় তত ভালো। কারণ ক্ষার জীবাণু মেরে ফেলে। এরপর মৃতদেহের গোসলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি নিজেও সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করে নেবেন। তার কাপড়চোপড় সাবান পানিতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে ফেলবেন,’ বলেন মুশতাক হোসেন। মৃত ব্যক্তিকে তার আত্মীয়-স্বজনরা গোসল করার আগে বা পরে দেখে নিতে পারেন বলে জানান তিনি। ‘গোসলের পর প্লাস্টিকের প্যাকেটে মরদেহ ঢেকে সিল করে দেওয়া হবে। সেখান থেকে পুরো বডিটা প্যাকেট করে কফিনে দিয়ে দেবে। মৃতদেহকে যত কম নাড়াচাড়া করা যায়। ওই পলিব্যাগসহই তাকে দাফন করতে হবে। জানাজা এবং দাফনের জায়গা একই হলে ভালো হয়।’
ডা. মুশতাক বলেন, কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন প্রক্রিয়ায় বেশি লোকজন জড়ো হতে নিরুৎসাহিত করেন তারা। তবে এতে ভয়ের কিছু নেই। মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়াবে বিষয়টা এমন নয়। কারণ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন চাইলে জানাজা এবং দাফনের সময় থাকতেই পারেন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে দেখতেও পারবেন। কিন্তু সবই মরদেহ প্যাকেট করার আগে। কারণ প্যাকেট খুললে ঝুঁকি থাকে।
মৃতের সংখ্যা বাড়লে তাদের সৎকার কীভাবে হবে- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মরদেহ দাফন করা হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়। বিভিন্ন হাসপাতালের যারা এ কাজে যুক্ত তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্যই আলাদা আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। সবই হবে প্রটোকল মেনে। মৃত ব্যক্তির পরিবার থাকলে আমাদের তত্ত্বাবধানে তাদের দাফন হবে। বেওয়ারিশ হলে তার দায়িত্ব দেওয়া হবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে। কিন্তু আমরা যখন ডেডবডি হ্যান্ডওভার করব তখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রটেকশন দেখা হবে।’
বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে তিনজন এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানায় আইইডিসিআর। এরপর প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা ধাপে ধাপে বাড়ছে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তদের মধ্যে প্রথম দফার তিনজন ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031