মার্টলি হুপারের জন্ম সে বছরে- ১৯১২ সাল যে বছর টাইটানিক ডুবেছিল। বর্তমানে তার বয়স ১০৭ বছর। এতদিনে দুনিয়ার অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন তিনি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ পার করেছেন। তার এখনো মনে আছে, স্প্যানিশ ফ্লু’র কথা। বাবা-মা’কে এ ব্যাপারে আলাপ করতে শুনেছেন। এতকিছু পার করে এখন আরেক বৈশ্বিক সংকট দেখছেন এই অস্ট্রেলীয় নারী। এই সংকটের নাম- করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯)।

সোয়ান হিল নার্সিং হোমের বন্ধ দরজার পেছনে থেকেও উপলব্ধি করতে পারছেন বাইরের পরিস্থিতি। হুপার বলেন, ‘মনে হচ্ছে, যেন কারাগারে আছি। এখানে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ এখান থেকে বের হতে পারছে না। কিন্তু আমাদের দেখাভাল করে চলেছে কর্মীরা।’ করোনা ভাইরাসের হানা থেকে বৃদ্ধদের রক্ষার্থে বিধিনিষেধ কঠোর করেছে অস্ট্রেলিয়া। তা সত্ত্বেও সিডনীর এক নার্সিং হোমে চার জনের মৃত্যু হয়েছে ভাইরাসটিতে। সোমবার থেকে সত্তুরের বেশি বয়স্কদের ও শারীরিকভাবে অসুস্থদের সেল্ফ-আইসোলেশনে থাকতে কঠোর নির্দেশ জারি হয়েছে। কভিড-১৯ এর সঙ্গে প্রতিনিয়তই স্প্যানিশ ফ্লুর তুলনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। মেলবোর্নে ওই ফ্লু প্রথম ধরা পড়েছিল ১৯১৮ সালে। হুপার তখন সবে ছয় বছর বয়সী। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে ভিক্টোরিয়া রাজ্যে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। নিষিদ্ধ হয়েছিল জমায়েত, ভ্রমণ। অস্ট্রেলিয়ায় প্রাণঘাতী ওই ফ্লু ও ব্যাক্টেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছিল প্রায় ১২ হাজার ৫০০ মানুষ। বিশ্বজুড়ে মারা গিয়েছিল অন্তত ৫ কোটি মানুষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সে সময় হুপারের জীবনযাপনে তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি। সাত বছর বয়সী হুপার নদীর পাড়ে ঘোড়া দৌড়িয়েছেন, স্কুলে গেছেন। উদ্বিগ্ন ছিলেন বয়স্করা। শিশুদের মনে ওই ফ্লু প্রভাব ফেলতে পারেনি। হুপার বলেন, আমি মনে করতে পারি যে, তারা এটা নিয়ে কথা বলছিল। সাত বছর বয়সে এসব ব্যাপার আপনার কাছে তেমন কিছু মনে হয় না, তাই না? হুপারের স্মৃতিতে ফ্লুর চেয়ে শক্ত হয়ে লিঙ্গ বৈষম্যতা। তিনি বলেন, ফ্লুর পরবর্তী বছরগুলোয় ছেলেদের শেখানো হতো সাঁতার কাটা, আর আমাদের শেখানো হতো কাপড় সেলাই করা। হয়তো, মেয়েরা ডুবে মারা যাওয়া অত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। প্রায় ২০ বছর পর, ১৯৩৯ সালে তার জীবনে প্রভাব ফেলে আরেক বৈশ্বিক সংকট- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হুপার তখন তার কনিষ্ঠ সন্তানের জন্ম দিতে হাসপাতালে ভর্তি। এমন সময় খবর এলো যে, পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করেছে জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ার ওই ছোট্ট দুনিয়ার বাইরে বাকি বিশ্বের সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় ছিল না বলা যায়। বর্তমানের অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। প্রতিনিয়ত নিজের বন্ধুদের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে পারছেন তিনি। ভাইরাসটির আগ্রাসন সম্পর্কে জানতে পারছেন। তিনি বলেন, এটা খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। প্রতিদিন বাড়ছে সংখ্যা। প্রিয়জনদের জন্য এটা খুবই ভীতিকর। আমরা প্রতিদিন ভাবি, এরপর কে? লকডাউনে থাকাকালীন হুপারের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নার্সিং হোমের ল্যান্ডলাইন। তার ইচ্ছা, এতে যেন ভিডিও কল করার অপশন থাকে। সাত বছর আগ পর্যন্ত আত্মনির্ভরশীল ছিলেন তিনি। কিন্তু ১০০ বছর পার করার পর ভাবলেন, এবার হয়েছে, নিজের দেখভালের দায়িত্ব নেয়া বন্ধ করা দরকার। তখনো নিজেই গাড়ি চালাতেন তিনি। ভাইরাস নিয়ে বেশ আতঙ্কে আছেন হুপার। ল্যান্ডলাইনে ফোন করার জন্যও তার অন্যের সাহায্য লাগে। কিন্তু একইসময়ে নিজের যত্ন নেয়ার ক্ষমতা হারানোর ভয়ও রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ১০৭ বছর। মানুষজন এখন আমাকে দেখতে আসে। এসে বলে, কিছু মনে না করলে, আমরা কী আমাদের শিশুদের আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারি? তারা এর আগে ১০৭ বছর বয়সী কাউকে দেখেনি। আমি জানি না, তাদের দেখে রানীর মতো হাত নাড়বো নাকি ললিপপ দেবো।’ হুপারের ৮০ বছর বয়সী ছেলে তাকে বলেছে, তার উচিৎ হাসপাতালের কাছে এরকম সাক্ষাতের জন্য টাকা চাওয়া। হুপার জানান, এই মহামারী পার করার জন্য তার কাছে তেমন কোনো উপদেশ নেই। গত শতকের সবচেয়ে বড় মুহূর্তগুলো পার করে আসা সত্ত্বেও কঠিন সময় পার করার কোনো বিশেষ বুদ্ধি জানেন না বলেই দাবি করেন তিনি।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031