দিন দিন বেড়েই চলছে মরণঘাতী করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা । বাংলাদেশের ৬০ টি জেলায় ছড়িয়েছে করোনা সংক্রমণ। দেশে চিকিৎসা নিয়ে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১২২ জন। এছাড়া আক্রান্তদের অনেকে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন রোগী হাসপাতাল ও বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কেন এমনটা হচ্ছে এ নিয়ে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিয়েছেন। তারা বলছেন, পরিস্থিতি সবার সামনে একেবারেই নতুন। কেউই বুঝে উঠতে পারছে না আসলে করনীয় কি।

করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্য ভয় ও আতঙ্ক কাজ করে। মৃত্যু ভয়ও চেপে ধরে তাদেরকে। পরিবার সমাজ থেকে আলাদা হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। এছাড়া হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসক/ নার্সদের সেবা, খাবারসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা না থাকায় রোগীরা মানিয়ে নিতে না পেরে হয়তো হাসপাতাল ছেড়ে যেতে চান। তবে কোন অবস্থাতেই রোগীদের হাসপাতাল ছাড়া উচিত নয় উল্লেখ করে তারা বলেন, হাসপাতালে থাকলেই তার সুস্থ হয়ে উঠার সুযোগ বেশি। পালিয়ে গেলে রোগ কমবে না। বরং অন্যের মাঝে সংক্রমণ ঘটবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনোবিদ অধ্যাপক ডা. এম এ মোহিত কামাল বলেন, মানুষ তখন পালায় যখন তার কাছে বিষয়টি ভয়ের কারণ হয়। এটি সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে তাদের মনে হতে পারে এতদিন অনেক মানুষের সঙ্গে ছিলাম। এখন একা হয়ে গেছি। পরিবার, পরিজন সমাজ থেকে দুরে। কেউ আমার সাথে আসতে চায় না, মিশে না। সবসময়ই তার মধ্য একটা আতঙ্ক কাজ করে। নিজেকে নি:সঙ্গ মনে হয়। মনের মধ্য মৃত্যুর ভয় কাজ করে। সে হয়তো মারা যাবে। এছাড়া হসপিটালে যদি চিকিৎসকদের কো-অপারেশন না থাকে তবে রোগী পালানোর চিন্তা করবে। এসব ভয় একসময় তার কাছে বড় হয়ে যায়। তিনি বলেন, মণতাত্ত্বিক ভয়ের পাশাপাশি হাসপাতালের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেবা দেয়ার মনমানসিকতা নিয়েই হাসপাতাল তৈরি করা হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা অনেক সময় রোগীর সঙ্গে কিভাবে কথা বলা প্রয়োজন সেটি তারা জানে না। তাই এই মুহূর্তে করোনা হাসপাতালে মনোবিদ বা সোশ্যাল ওয়ার্কার নিয়োগ দেয়া দরকার। তারা রোগী ও চিকিৎসকের সঙ্গে কাউন্সিল করবে। রোগীর মনোবল বাড়াবে। কারণ চিকিৎসকরা রোগীদের এত সময় দেয়া সম্ভব হয় না। আর চিকিৎসকরা কিভাবে রোগীর সঙ্গে কথা বলবে সেটি কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে বুঝাবে। না হলে করোনা রোগীদের মধ্যে যে ভয় আতঙ্ক বিরাজ করছে সেটি দুর হবে না। বরং ভয়ে রোগীরা পালিয়ে যাবে। আর করোনা রোগী পালিয়ে গেলে সেটি ভয়ের কারণ। কারণ সে পালিয়ে গিয়ে তার পরিবার পরিজনসহ আরও অনেককে আক্রান্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা রোগী পালানোর ক্ষেত্রে রোগীদের মধ্য একটা মনোস্তাত্ত্বিক বিষয় কাজ করে। তারমধ্য হয়তো একটা ভয় কাজ করে। এছাড়া হাসপাতালে যখন সবকিছু ঠিকমত হয় না। অনেক করোনা রোগীরা অভিযোগ করে হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না। ডাক্তার আসে না। এসব অভিযোগ কতটুকু সত্য সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। তবে যারা পালিয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বললে জানা যেত তারা কেন পালিয়েছে।
এদিকে করোনা রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসার মান, পরিবেশ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগের শেষ নাই। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে রোগীরা পালাচ্ছে। সরকার নির্ধারিত করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীরা হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনার তথ্য তুলে ধরেছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ দিন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন  ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ভিডিও গ্রাফার আশিকুর রহমান রাজু। সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, প্রথম দিন হাসপাতালে গিয়েই মনে হয়েছিলো ভূতের বাড়ি। সেখানে যাওয়ার পর সবাই ছিল দূরে দূরে। দূর থেকে দেখিয়ে দেয়া হলো সামনে ওয়ার্ডে গিয়ে যেটা বেড খালি আছে সেটায় শুয়ে পড়ার জন্য। হাসপাতালে যাই বিকাল তিনটায় আর  রাত ৯টায় চিকিৎসকরা আমাকে দেখতে আসে।  অনেক পর ডাক্তার-নার্স এসে রোগীদের নাম ধরে অবস্থা জানতে চান। রোগীদের সময়মত খাবার দেয়া হতো না। খাবারের মানও ভালো ছিল না।  রোগীরা নিজেরাই নিজেদের গিয়ে ওষুধ ও খাবার সংগ্রহ করতে হতো।
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন এক নারী। গত বুধবার তিনি একটি মৃত শিশুর জন্ম দেন। হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে ওই নারীর শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। পরে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। পরেরদিন বৃহস্পতিবার তার করোনা পজিটিভের খবর আসলেও তাকে আর খোঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। তার স্বামীর বাড়ি ও বাবার বাড়ির ঠিকানায় গিয়েও তাকে খোঁজে পায়নি পুলিশ। গত সপ্তাহে করোনার উপসর্গের তথ্য গোপন করে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ভর্তি হন। চিকিৎসকরা তার শরীরে করোনার উপসর্গ দেখে নমুনা সংগ্রহ করে করোনা পরীক্ষার জন্য পাঠান। ২০ এপ্রিল সোমবার তার করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে আইসোলেশনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে সেই রোগীকে আর খোঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ভর্তির সময় সে যে ঠিকানা দিয়েছিল সেখানে তার খোঁজ মিলেনি। পরে খিলক্ষেত থানা থেকে ওই ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য চান্দগাঁও থানায় পাঠানো হয়। পরে পুলিশ প্রযুক্তির সহযোগীতায় ওইদিন রাতেই ফেনীর সদর থানার সহায়তায় তাকে আটক করে। রাতে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশনে পাঠানো হয়। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এমন আরও বেশ কয়েকজন রোগি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে রাখা এক ব্যক্তি জানালা কেটে পালিয়ে যান।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031