রাজীব নামের এক যুবক শুক্রবার কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। দুর্ঘটনার পর স্বজনরা চিকিৎসার জন্য তাকে প্রথমে নিয়ে যান কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে তার চিকিৎসা হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। সঙ্গে সঙ্গে স্বজনরা তাকে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসেন পঙ্গু হাসপাতালে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত চারদিন ধরে কুষ্টিয়া ও ঢাকার চারটি হাসপাতালে সাতবার ধরনা দিয়ে অবশেষে রাজীবের জায়গা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। এই চারদিনে রাজীবের স্বজনদের সীমাহীন ভোগান্তির পাশাপাশি অন্যান্য খরচের পাশাপাশি এম্বুলেন্স ভাড়া দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা।
রাজীবের স্বজন নাসির জানান, কুষ্টিয়া থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে আনার পর জরুরি বিভাগ থেকে জানানো হয় এই রোগীর চিকিৎসা সেখানে হবে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) নিয়ে যেতে হবে। এরপর
রাজীবকে ঢামেকের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। সেখান থেকে আবার পাঠানো হয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। সেখানে আমাদের বলা
হয় আবার পঙ্গু হাসপাতালে নিতে হবে। পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে গেলে ফের আমাদের
পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। অনেক আকুতি মিনতি করার পর
তারা আবার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠান। নাসির বলেন, চারদিন ধরে এভাবে একের পর
এক হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রাজীবকে আমরা পঙ্গু হাসপাতালেই ভর্তি করাই।
দুর্ঘটনায় আহত রোগীর শরীরে প্রচুর যন্ত্রণা থাকে। চোখের সামনে রাজীব ব্যথার
যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলো। কিন্তু আমরা তার জন্য কিছুই করতে পারিনি।
চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা নিয়ে এসেছিলাম। এভাবে ধরনা দিতে হবে জানলে তাকে
ঢাকা নিয়েই আসতাম না।
শুধুমাত্র রাজীবের বেলায় এমনটা ঘটছে না।
সরকারদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে খোদ চিকিৎসকরাই করোনাকালীন
সময়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার অভিযোগ এখন অহরহ।
সোমবার রাতে করোনার উপসর্গ নিয়ে ঢাকার তিন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে
মারা গেছেন বরিশালের রাহাত-আনোয়ার হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও অর্থোপেডিক
সার্জন ডা. আনোয়ার হোসেন। মঙ্গলবার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম সগীর।
ওইদিন সকালে তিনি স্ট্রোক করার পর নেয়া হয় নগরীর জিইসি মোড়ের মেডিকেল
সেন্টারে। সেখানে আইসিইউ ও চিকিৎসক না থাকার অজুহাত দেখিয়ে ভর্তি নেয়া হয়নি
সগীরকে। পরে তাকে নেয়া হয় মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। একই অজুহাতে সেখানেও
চিকিৎসা জোটেনি এই আওয়ামী লীগ নেতার। পরে নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে
গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সগীরের ভাই রফিক আক্ষেপ করে বলেন, এই শহরে এত
হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসক থেকেও আমার ভাইয়ের চিকিৎসা হয়নি তাকে বাঁচাতে
পারি নাই।
চিকিৎসক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশপাশি বিনা চিকিৎসায়
ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার সিলেটের চারটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা
পাননি মূত্রনালির সংক্রমণের রোগী নগরীর কুমারপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও সিলেট
চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য ইকবাল হোসেন। স্বজনরা
জানিয়েছেন, শুক্রবার ভোর থেকে ইকবালের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরে এম্বুলেন্সে
করে প্রথমে তাকে আল হারমাইন হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার
ভর্তি না নিয়ে নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। আইসোলেশন শয্যা খালি
নাই বলে সেখান থেকেও ফিরিয়ে দেয়া হয়। তারপর শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ
হাসপাতালে নিয়ে গেলে কাউকে না পেয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা ইকবালকে মৃত ঘোষণা করেন।
পহেলা
জুলাই সিলেটের ছয় হাসপাতাল ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মারা যান ৭০ বছর বয়সী এক
বৃদ্ধা। স্ট্রোকের এই রোগীকে শ্রীমঙ্গল থেকে প্রথমে মৌলভীবাজার সদর
হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে আইসিইউ সাপোর্ট না থাকায় নেয়া হয় নর্থইস্ট
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি না নিলে একে একে নগরীর আল হারমাইন
হাসপাতাল, ইবনেসিনা হাসপাতাল, মাউন্ট এডোরা হাসপাতাল, সিলেট উইমেন্স
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নূরজাহান হাসপাতাল। কোথাও মিলেনি চিকিৎসা। পরে রাত
দেড়টার দিকে তাকে ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত
ঘোষণা করেন। এর দুদিন আগে মনোয়ারা বেগম নামের আরেক নারীকে সিলেটের একের পর
এক হাসপাতাল ঘুরে ভর্তি করাতে না পেরে এম্বুলেন্সেই বৃদ্ধার মৃত্যু হয়।
মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে ৬ হাসপাতাল ঘুরে বিনা চিকিৎসায় গত
বৃহস্পতিবার মৃত্যুবরণ করেন হাজী মো. এনায়েত উল্লাহ নামের ৭২ বছর বয়সী এক
বৃদ্ধ। এনায়েত উল্লাহর ছেলে জানান, ওইদিন সকালে বাবা অসুস্থতাবোধ করলে
প্রথমে বরপার ইউএস-বাংলা হাসপাতাল, ডেমরার সানারপাড়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ ছয়টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা মিলেনি।
অবশেষে সন্তানদের চোখের সামনে বিনা চিকিৎসায় ওই বৃদ্ধ গাড়িতেই মারা যান।
হাসাপাতালের
সামনে রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষা: এদিকে ঢাকার সরকারি হাসপাতালের সামনে
প্রতিদিনই রোগী ও স্বজনদের অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। করোনা উপসর্গ ছাড়া
আনুষঙ্গিক রোগীরাও চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করেন। করোনা ডেডিকেটেড
হাসপাতালগুলো করোনা পজিটিভ ছাড়া রোগী ভর্তি নিচ্ছে না। আবার অন্যান্য
হাসপাতালে নানান ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। রোগীরা অভিযোগ করে
বলেন, করোনা পজেটিভ ও উপসর্গ না থাকলে অনেক হাসপাতালে রোগী ভর্তি নিচ্ছে
না। তারা করোনা রোগী কিনা সেটি নিশ্চিত হয়ে ভর্তি নেয়। যে সমস্ত রোগীদের
করোনা পরীক্ষা করা না থাকে তাদের করোনা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখিয়ে ভর্তি করতে
হয়। কিন্তু অনেক সময় অনেক মুমূর্ষু রোগী থাকে যাদের করোনা পরীক্ষা করিয়ে
রেজাল্ট আনতে সময় লাগে। সেই সময়টাতে রোগীদের অবস্থাও যেমন খারাপ হয় আবার
অনেক সময় অনেক রোগী মৃত্যুবরণ করেন।
গতকাল সরজমিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসান আলী (৬০) নামের এক রোগীকে।
রোগের চাপে তার শরীর নুইয়ে গেছে। শরীরে পোশাক বলতে মাত্র একটা লুঙ্গি। আর
রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় একটুকরো কাপড়। বসে আছেন হাসপাতালে বাইরে। পাশেই ছোট
একটি পানির বোতল। অসুস্থ শরীরে উত্তপ্ত গরমে অনেকটা নিস্তেজ তিনি। পাবনা
থেকে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। সঙ্গে এসেছেন ছেলে ও ছোট ভাই। তাদের জন্য
অপেক্ষায় অসহনীয় সময় কাটছিলো তার। কারণ তারাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাবে।
হাসান আলী জানান, পাবনা থেকে বাসে করে ঢাকায় এসেছেন। আসার পর প্রায় ২ ঘণ্টা
ধরে বাইরে বসে আছেন। এরপরেও ভর্তি হতে পারেননি। তার সঙ্গে মোবাইলও নেই।
ছেলে ও ভাই কখন আসবে জানেননা। একটু পর পর তার পেটে ব্যথা করছে। একজন লোক
রুটি আর একটা পানির বোতল দিয়ে গেছে। এটা খাইছি। এতটাই অসুস্থ পানির বোতলটা
খুলতেও পারছিলেন না তিনি। আরেকজন মানুষ আসে পানির বোতলটা খুলে দিয়ে গেছে।
এই হাসপাতালেই দেখা মেলে আরেক রোগীর। একটি এম্বুলেন্সে করে এসেছেন
মুন্সীগঞ্জ থেকে। রোগীর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। অসুস্থ মহিলার নাম
রেহেনা শারমিন। পাশে মেয়ে সাজিয়া রহমান। তিনি বলেন, মায়ের আগে থেকেই
শ্বাসকষ্টের সমস্যা। হঠাৎ করেই বুধবার ভোরে বেড়ে যায় তা। মাকে নিয়ে
হাসপাতালে এসেছি। আসার পরেই জানানো হয়, করোনা পরীক্ষা না করিয়ে ভর্তি নেয়া
যাবে না। মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি আরও
বলেন, মুন্সীগঞ্জে ৪টা হাসপাতালে যোগাযোগ করা হয়েছে কেউ ভর্তি নেয়নি। সবাই
বলে করোনা পরীক্ষা আগে করানোর জন্য। কিন্তু এই অল্প সময়ে তো আর করোনা
পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। ঢাকার শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, গেটের সামনে মা
বাবার সঙ্গে ছোট একটি মেয়ে, নাম ইফ্রাদ শারমিন। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বয়স ৪
বছর। হঠাৎ তার শরীরে র্যাশ ওঠা শুরু করেছে তাই চিকিৎসকের কাছে আনা হয়েছে।
সকাল থেকে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর ডাক্তার দেখাতে পারেন। কিন্তু তিনি
অভিযোগ করেন দূর থেকে ডাক্তার দেখেন। কোনো কিছু ভালো করে না দেখেই শুধু
ওষুধ দেয়। তার ঠিক পাশেই বাবা সুমন খানের কোলে ছোট ছেলে সৃজন খান (৩)। মা
বারবার চেষ্টা করছিলেন মাস্ক পরানোর কিন্তু কোনাভাবেই মাস্ক পড়বে না সৃজন।
এই শিশুর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে। ৫দিন আগে
হাসাপাতালে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শুধুই প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়
তাকে। এরপর অবস্থার অবনতি হলে নিয়ে আসেন ভর্তি করানোর জন্য। বাবা বলেন, এখন
ভর্তি নিচ্ছে না। এই ৫দিনে প্রায় ২ কেজি ওজন কমে গেছে ছেলেটার। কিছু খায়
না। প্রচণ্ড দুর্বল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতির শুরু
থেকেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে যখন করোনার
তাণ্ডব চলছে ঠিক তখন এই অভিযোগ এখন দেশের সর্বত্রই জোরেশোরে উঠছে। করোনা
পজেটিভ রোগীদের জন্য সরকারের ডেডিকেটেড হাসপাতাল বরাদ্দ থাকলে সাধারণ
রোগীরা নানান ভোগান্তি ও হয়রানিতে পড়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ডেডিকেটেড
ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালে আনুষঙ্গিক রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলা
হলেও অনেক সময় হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নিচ্ছে না। হাসপাতালগুলো
যেখানে রোগীই ভর্তি নেয় না সেখানে চিকিৎসার মান ও সেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠা
অনেকটা স্বাভাবিক বিষয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ধীরে ধীরে যেভাবে
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তাতে এক সময় দেখা যাবে হাজার হাজার মানুষ বিনা
চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছে।
