ইতিহাস সবসময় পুরোপুরি সত্য বলে না। ইতিহাসকে তাই বুঝতে হয়। নানা ভাবে ভাবতে হয়। কলম্বাস ইউরোপ থেকে এসে আমেরিকাতে পা রাখলেন কোনো আবিষ্কারের নেশায় নয়, লুটপাটের আকাঙ্খায়।

ইউরোপের লুটেরা লুম্পেন দেশগুলোর রাজাদের সম্পদের খায়েশ মেটাতে নতুন নতুন উপনিবেশ তৈরি ও শোষণের প্রতিযোগিতায় স্পেনের রানী ইসাবেলার জুয়ার ঘোড়া ছিলেন কলম্বাস।

কলম্বাস আসার আগেই তো আমেরিকার মূল ভুখন্ডে মানুষ ছিল। তারপরেও তারা বলে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন।

আমেরিকার ভুখন্ডটিকে নানা নামে ডাকতো আদিবাসিরা। কুনা ভাষায় তারা এটাকে বলতো আবায়া ইয়ালা। সমৃদ্ধ ভুমি। পাচামামা ছিল পৃথিবীর নাম। তারা ভাবতো পাচামামার কোলে তার সন্তান আবায়া ইয়ালা শূয়ে আছে।

সেই ভাষা নাই। সংস্কৃতি নাই। ইউরোপিয়ানদের ওরা বলত ডিগার বা গর্তখোঁড়ার দল। কারন ওরা যেখানে সেখানে গর্ত করে সোনা খুঁজত, তুলে নিত প্রাকৃতিক সম্পদ। সেই গর্ত খোঁড়ার দল নিয়ে নিল তাদের ‍পিতৃপুরুষের ভূমি।

আবায়া ইয়ালা এখন হয়ে গেছে আমেরিকা , আদিবাসী রাজার বদলে অর্ধোন্মাদ ট্রাম্প শাসন করে দুনিয়া! সাদারা কেউ তো আমেরিকান না, ওরা সব ইউরোপিয়ানদের বংশধর। আগ্রাসী ভুমি দখলকারী।

যে জীনস পরা কাউবয়রা তাদের ভুমি কেড়ে নিয়েছিল, সেই একই রকম কাউবয় জীনস পরে এখন আদিবাসীরা ডাকোটা পাইপলাইন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। জাতির পরিচয় হারিয়ে তারা পেয়েছে নো ডাকোটা পাইপলাইন লেখা টি শার্ট আর জীনসের পাতলুন।

অর্ধমুর্খ কলম্বাস বাদামী চামড়ার মানুষ দেখে ভেবেছে সে ভারতে এসেছে আর এরা সবাই ভারতীয়। তাই আমেরিকার আদিবাসিরা হয়ে গেল রেড ইন্ডিয়ান বা লোহিত ভারতীয়। এভাবেই ইতিহাস কেবল কিছু লুটেরার মহিমা প্রচার করে ।

আমরাও ছিলাম ইউরোপের উপনিবেশ। আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো আমাদের শেখায়, ভাস্কো ডাগামা উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে ভারতে আসার সহজ পথ আবিস্কার করেন। কার জন্য সহজ পথ? আমাদের জন্য? না, ইউরোপিয়ান বনিকদের জন্য।

এই রাস্তা আবিষ্কারের কারনে গামার দেশ পর্তুগাল পোপের এক আদেশবলে এই রাস্তায় কোনো জাহাজ আসলে তার কাছ থেকে তোলা বা চাঁদা নিত।

কেপ অফ গুড হোপের নাম বাংলায় লেখা উচিত উত্তম আশা অন্তরীপ। সেটাকে লেখা হয় উত্তমাশা অন্তরীপ। আমার এক বন্ধু ছোটবেলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা আবার কোন ধরনের ”আমাশা” মানে আমাশয়।

এভাবে আক্রমনকারী কলম্বাস , লোভী ভাস্কো আর দু:শাসক কার্জন আমাদের ইতিহাসে জায়গা পেয়ে যান। দেশে কার্জন হল আছে, ক্ষুদিরামের নামে একটা চালাঘর নাই। ইংরেজের দালাল নবাবদের মঞ্জীল আছে, প্রীতিলতার একটা ভালো ভাস্কর্য নাই। কেমন ছিলেন দেখতে তিতুমীর, নূরল দীণ বা ফকির মজনু শাহ? তাদের ছবি কেন কোথাও নাই?

এই মানুষগুলোই তো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন পরাধীনতার অন্ধকারে। সূর্যসেন, প্রীতিলতা , ক্ষুদিরামরা তো আমাদের বীর শ্রেষ্ঠদের পূর্ব পুরুষ।

আমাদের উচিত থেমিস নামের শাড়ী পরা উৎকট গ্রীক দেবীর ভাষ্কর্য না বানিয়ে, আমাদের স্বাধীনতার ৭ বীর শ্রেষ্ঠ, বাংলার স্বাধীকারের দাবীতে সংগ্রামী বিপ্লবীদের ভাষ্কর্য স্থাপন করা।

আমাদের ইতিহাস আমরা লিখব। যেখানে আমরা গর্বের সংগে জানব বাংলা ছিল মুঘল ও বৃটিশদের সবচেয়ে বেশি কর দেওয়া অঞ্চল। আমরা তাদের কোষাগারে সবচেয়ে বেশি দিতাম কারন আমরা ধনী ছিলাম।

পৃথিবীর ২০ ভাগ সম্পদ ছিল ভারতে। কৃষিভিত্তিক সেই অর্থনীতির যুগে আমরা ছিলাম সবচেয়ে ধনী প্রদেশ। আমাদের মাংসের সাথে মাছ ছিল। থালা ভরা ভাত ছিল। দুধ ছিল , ডিম ছিল। ছিল তাঁতের কাপড়। ছিল অলংকার তৈরির পারদর্শিতা।

ভারতে সব জায়গায় বছরে একটা ফসল, শুধু আমাদের দুটো আর পাঞ্জাবে। আমাদের ইতিহাস আমরা লিখি না। তাই আমাদের দেশ ভরে যায় অর্ধেক ইংরেজীতে কথা বলা বাদামী সাহেবে। লর্ড মেকলে নরক থেকে হাসেন আর ভাবেন , তার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আমরা এখন a community of brown englishmen. আমরা সব বাদামী সাহেবের দল। সাদা কাকের লেজ পরা ময়ূরের দল।

লেখকঃ গণমাধ্যম ব্যক্তিতে ও চিকিৎসক

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031