গবেষণায় উঠে এসেছে শুরুতে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ত্রুটি ছিল বলে । বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের গবেষণায় এই চিত্র পাওয়া গেছে। গতকাল প্রকাশিত সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত সোয়াব স্টিকের
ঘাটতির কারণে অন্তত ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে তুলার পরিবর্তে কাপড় লাগানো সোয়াব ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সময়ে সোয়াব স্টিকের পরিবর্তে ঝাড়ুর শলাকা, কাঠ, এমনকি চুলের ক্লিপ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয় পরীক্ষার ক্ষেত্রে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ওষুধ, পরিপূরক খাবার এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা রোগীদের জন্য নিরাপদ হলেও গবেষণায় পাওয়া উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, ওষুধের জন্য রোগীদের গড়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। এমনটা হওয়ার কারণ মূলত কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত মূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহের ঘাটতি।
গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিল ও মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত সোয়াব স্টিকের ঘাটতির কারণে অন্তত ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে তুলার পরিবর্তে কাপড় লাগানো সোয়াব ব্যবহার করা হয়েছিল। এই সময়ে সোয়াব স্টিকের পরিবর্তে ঝাড়ুর শলাকা, কাঠ, এমনকি চুলের ক্লিপ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছে। নিয়ম হলো নমুনা সংগ্রহকালে সোয়াব স্টিক নাকের পেছনে গলার উপরিভাগে পুরোটা ঢুকিয়ে আলতোভাবে ঘষে ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা; কিন্তু ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি।
মহামারির শুরুতে আইইডিসিআর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এককভাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেছে। কিন্তু এই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার চাপ সংস্থাটির সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। করোনাভাইরাস পরীক্ষার সুবিধা সমপ্রসারণে দেরি হওয়ায় বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক নমুনার পরীক্ষা জমে গিয়েছিল। যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের অভাবে মধ্য এপ্রিল থেকে নমুনা পরীক্ষা করার বিষয়টি আরো নাজুক হয়ে পড়েছিল। নমুনা সংগ্রহের তুলনায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার অপ্রতুলতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। তার উপর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে অনেক জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহের গতি ও পরিমাণ কমতে শুরু করে। মধ্য জুনের মধ্যে সারা দেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আক্রান্তও হওয়ার সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। গবেষণায় পরীক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক ত্রুটির সন্ধান মেলে। যার মধ্যে অনুপযুক্তভাবে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কারণে কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ নানাবিধ বিষয়াদি রয়েছে। নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সংক্রমিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণে হাত না ধোয়া, ল্যাবরেটরিতে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা ইত্যাদি। পরীক্ষা করার জন্য ফি চালু করার ফলে পরীক্ষার সংখ্যা কমে যায়।
গবেষণা দেখা যায়, করোনার অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিকল্প চিকিৎসা নিয়েছে করোনা রোগীরা। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টিও দেখা হয়েছিল। এই বিষয়টি সম্পর্কে জানা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ বাংলাদেশের বেশির ভাগ কোভিড-১৯ রোগী হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ওষুধের একটি গাইডলাইন প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু গবেষণায় জানা গেছে যে, এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়নি। ফলে আক্রান্তরা এলোপ্যাথিক ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পরিপূরক বা সাপ্লিমেন্টারি ওষুধের পাশাপাশি হার্বাল চিকিৎসা ও দেশীয় চিকিৎসা নিয়েছেন। যা মূলত মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা জনপ্রিয়তা পায়। সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে এমন সব রোগীই প্যারাসিটামল খেয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের পরিপূরক খাবার যেমন লেবু/কমলাজাতীয় ফল ও অতিরিক্ত আমিষ জাতীয় খাবার খেয়েছেন। এ ছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের অপ্রমাণিত কিন্তু জনপ্রিয় ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়েছেন। যেমন-গরম পানির গড়গড়া করা (৮৪ শতাংশ), গরম পানির বাষ্প শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে টানা (৭৯ শতাংশ) এবং গরম পানি খাওয়া (৭৬ শতাংশ) ইত্যাদি ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। উল্লিখিত ওষুধ, পরিপূরক খাবার এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা রোগীদের জন্য নিরাপদ হলেও গবেষণায় পাওয়া উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো, ওষুধের জন্য রোগীদের গড়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। এমনটা হওয়ার কারণ মূলত কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত মূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহের ঘাটতি হওয়া
সংস্থাটির এর আগের গবেষণাগুলোতে বলেছে, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশে শুরুর প্রথম দুই মাসে সম্মুখসারির কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম পৌঁছানো নিয়ে বড় ধরনের সংকট ছিল। গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে পরিচালিত জরিপে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুতির অস্বস্তিকর একটা চিত্র দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তবে, সামগ্রিকভাবে কোভিড-১৯ এবং পিপিই ব্যবহারের হার এখনো অনেক কম এবং ৫০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা পিপিই’র মান নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন।
সংস্থাটি কিছু সুপারিশ করেছে। এতে বলা হয়, জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ও নির্দেশনার উপযুক্ত বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও স্থানীয় সরকারকে সমপৃক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ-সমৃদ্ধ কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে সম্ভাব্য সংক্রমণের ক্ষেত্রে দ্রুত শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত প্রক্রিয়াযুক্ত স্টেকহোল্ডারদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলোর দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে।
