বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্য, অনুপস্থিত শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেয়া, কলেজ ফান্ডের অর্থ লোপাট, নিয়মিত কলেজে উপস্থিত না থাকাসহ ডজনের বেশি অভিযোগ । কলেজটির অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা
যায়, ২০১৭ সালের ১৩ই মার্চ  থেকে ২০১৮ সালের ১৫শে নভেম্বর পর্যন্ত নৈশ বিভাগের ওপিডি’র রোগীদের থেকে প্রাপ্ত টিকিট বিক্রির ২৬ লাখ ৫৪ হাজার ৫৫০ টাকা জমা থাকার কথা থাকলেও ব্যাংকে জমা হয়েছে ২৩ লাখ ৩ হাজার ১৪০ টাকা। এই  ঘটনায় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৪১০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কলেজটির বার্তাবাহক মাসুদ হাসানকে। এর আগে ২০১৬ সালে ওপিডি’র নৈশ বিভাগের ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪০ টাকার অনিয়মের সন্ধান পাওয়া যায়। সে সময় অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের দায়ে কলেজের কম্পাউন্ডার আলফাজ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ওই ঘটনায় গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তে ওপিডি’র টাকার অনিয়ম রোধ করতে নৈশ ও দিবা শাখার উপাধ্যক্ষদের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ রেগুলেশন-১৯৯৬  অনুসারে  ‘ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট’ এর দায়িত্বের বিষয়ে বলা আছে, হাসপাতালে প্রশাসনিক কাজে ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হচ্ছেন সুপারিনটেনডেন্ট এর প্রধান সহকারী। সুপারিনটেনডেন্টর এর অনুপস্থিতিতে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।’ অন্য আরেকটি ধারায় লেখা রয়েছে, ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হবেন হাসপাতালের ডিফেক্টর একাউন্টস অফিসার। সকল প্রকার লেনদেনের জন্য তিনি হাসপাতালের একাউন্ট এবং স্টোরের একাউন্টস রাখার ব্যাপারে দায়ী থাকবেন।

অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ রেগুলেশন-১৯৯৬ এর নীতিমালা বহির্ভূতভাবে একজন কম্পাউন্ডার ও একজন বার্তাবাহকের চাকরিচ্যুতির ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে কলেজ প্রশাসনের উপর।

কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ‘মাসুদ হাসানকে যে টাকা আত্মসাতের দায়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, চাকরিচ্যুত করার পরই নৈশ বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. আবু নাসের আত্মসাতের সাড়ে তিন লাখ টাকার ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা কলেজ ফান্ডে জমা করেন।’ এর আগের ১১ লাখ টাকা আত্মসাতে একই ঘটনা ঘটেছে বলে জানান ওই শিক্ষক। যে টাকা আত্মসাতের দায়ে মাসুদ হাসানের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে সেই টাকা কলেজের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ হাসান বলেন, ওই টাকা জমার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমি জমা করিনি। আমাকে চাকরিচ্যুত করা হলো। কিন্তু টাকাতো আমি নেইনি। যেই মেডিকেল অফিসারের স্বাক্ষরে তছরুপের টাকা কলেজের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে সেই মেডিকেল অফিসার  ড. আবু নাসের বলেন, ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে টাকা দিয়েছে আমি জমা করেছি।’
জানা যায়, এই ঘটনায় নিজেদের দায় এড়াতে উল্টো বার্তাবাহক মাসুদ হাসানের বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় গত বছর ২০শে অক্টোবর একটি সাধারণ ডায়েরি করেন অধ্যক্ষ। আর ২০১৯ সালের ২৮শে জুলাই তাকে সাময়িক ও ২০২০ সালের ২৭শে অক্টোবর স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। তবে কলেজের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরো বেশকিছু অনিয়মের খবর। তদন্তে এক ডজনেরও বেশি অনিয়মের প্রমাণ হওয়ার পরও এতে স্বাক্ষর করেননি কলেজের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট দিবা বিভাগের উপাধ্যক্ষ ডা. এবিএম বজলুল হাসান। এমনকি গভর্নিং বডির তদন্ত কমিটি লিখিত বক্তব্য চাওয়া হলেও ওই প্রতিবেদনে কোনো বক্তব্য প্রদান করেননি। এমনকি পরবর্তী বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানেও তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি।
কলেজের ওপিডি’র টাকার তছরুপের ঘটনায় অনুসন্ধানে নৈশ বিভাগের উপাধ্যক্ষ ডা. আবদুল জলিল মণ্ডল লিখিত বক্তব্যে বলেন, প্রয়াত রেজিস্ট্রার ডা. গোলাম মোস্তফার প্রভাব মাসুদ হাসানের ওপর ছিল। তিনি তাকে ব্যক্তিগত পিয়ন হিসেবে ব্যবহার করতেন। অফিসের কাজ রেখে তাকে তিনি নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। ফলে মাসুদ হাসান নিয়মিত ব্যাংকে টাকা জমা না করে ৪/৫দিন পর পর টাকা জমা করতো। মাসুদ হাসানের মাধ্যমে প্রায়ই ক্যাশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা করে নিতো।’ ওই প্রতিবেদনে এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন হিসাবরক্ষক শাহ্‌জাহান সরকার। লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন- ‘টাকার অনিয়মের এই বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পরও ব্যবস্থা গ্রহণ করনেনি।’ ওপিডি’র নৈশ বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. আবু নাসের তদন্ত কমিটিকে এই বিষয়ে উল্লেখ করেন-  ‘অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষকে অভিহিত করা হয়েছে। বারবার অভিযোগ করার পরও তারা এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথিক  মেডিকেল কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউর রহমান এডভোকেট বলেন, এর আগে একজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে আমি জানি। গভর্নিং বডির চেষ্টায় সেই টাকা উদ্ধার হয়েছে। নতুন একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে শুনেছি। আমি এই বিষয়ে গভর্নিং বডিকে জানাতে বলেছি। অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের বিষয়ে কথা বলেছেন কলেজেটির গভর্নিং বডির সদস্য অধ্যাপক ড. এসএম আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, কলেজের বিষয়ে আমার কাছেও এর আগে অনেক অভিযোগে এসেছে। অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালের ল্যাবটি আট বছর আগে অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্যদিকে ল্যাবের পরীক্ষা-নীরিক্ষা থেকে আয়ের একটি অংশ লোপাট হয়েছে। কাগজপত্রে দেখা যায় ল্যাবের রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ অর্থ কলেজ ফান্ডে জমা পড়েনি। এমনকি চেয়ার টেবিল কেনার ভাউচার থাকলেও তা কেনা হয়নি বলে জানা যায়।
কলেজটির আরও একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,  কলেজের প্রায় বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি অকেজো। এর মধ্যে কিছু যন্ত্রপাতি যেমন বেশ কয়েকটি কম্পিউটার, প্রিন্টারসহ অনেক চেয়ার টেবিল ও অন্যান অনেক যন্ত্রপাতিই কলেজ থেকে উধাও। একইভাবে গভর্নিং বডির গত বছর ১২ই ফেব্রুয়ারি গঠিত প্যাথলজি ল্যাবের তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায় ল্যাব চালু হওয়ার পর থেকে ২০১২ সালে প্যাথলজি টেস্টের ৩২ হাজার ৮২৭ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাফির ১৮ হাজার ৪০০ টাকা, ল্যাব টেস্ট ও আল্ট্রসনোগ্রাফির ৫১ হাজার ২২৭ টাকা আয় করলেও ব্যাংকে এসব টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। একইভাবে রি-এজেন্ট টেস্ট টিউব, বেতনসহ প্রায় বিশাল অংকের অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। কলেজের ২ লাখ ৯৭ হাজার ২৩১ টাকা ঘাটতি ধরা পড়ে।
২০১৯ সালের ২০ ও ২৭শে  এপ্রিল অনুষ্ঠিত হোমিওপ্যাথিক পোস্ট ডিপ্লোমা ট্রেনিং-পিডিটি (হোম) কোর্সে মোকাদ্দেস হোসেন নামে এক ছাত্র পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকেলও তাকে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। এই বিষয়ে কলেজের অফিস সুপার ডা. নরুল আমিন বলেন, মোকাদ্দেস আহমেদ পরীক্ষা দেননি। উপরের নির্দেশে তাকে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031