করোনা হয় যারা ফ্ল্যাটে থাকে। আমাগো করোনা হয় না। এভাবেই বলছিলেন পোশাক শ্রমিক আশা। রায়েরবাজার বোর্ডঘাট বস্তিতে রোদের তাপ গায়ে মাখতে ব্যস্ত ছয়জন। এরমধ্যে দু’জন ক্যারম বোর্ড ভেঙে তৈরি করছিলেন জ্বালানির খড়ি। করোনার কথা আসমানী আশা হেসে উড়িয়ে দেন
। পোশাক শ্রমিক আশার হাসি ছড়িয়ে যায় সবার মুখে।
বস্তির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। খাল না বলে এটাকে ময়লার স্তূপ বললেও ভুল হবে না।

ভেসে আসছিল উটকো গন্ধ। এই খাল পাড়ের দু’পাশ মিলে ১৮০টি ঘর। প্রতিটি ঘরে একটি করে পরিবারের বাস। অনেক খোঁজ করেও মেলেনি কোনো করোনা আক্রান্ত রোগী। বস্তিবাসীরা জানান, এখানে কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। এমনকি উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুও হয়নি কারো।

বস্তিুর ভিতরে সেলুনে কাজ করছিলেন নরসুন্দর খোকন চন্দ্র শীল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই বস্তির কোনো ঘটনা ঘটলে সবাই জানতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে যায় কথা। এখানে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয় নাই। আমি শিওর।
বস্তিটিতে করোনার উপসর্গ ছিল এবং আছে অনেকের। জ্বর, সর্দি, কাশি যাদের ছিলো বা আছে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খেয়েই সেরে গেছে তা। এমন আট জন এই বস্তিতে মেলে যাদের উপসর্গ ছিল কিন্তু টেস্ট করাননি।
অনেক খুঁজে একজনকে মেলে যিনি করোনার টেস্ট করিয়েছেন। বাদশা মিয়া, বয়স আনুমানিক ৪০ বছর। তিনি কাজ করেন একটি বেসরকারি অফিসের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে। বাদশা মিয়া বলেন, অফিসেই টেস্ট করার ব্যবস্থা করে। চারদিন পর টেস্ট নেগেটিভ আসে।
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সড়ক সংলগ্ন সোনা মিয়ার টেক বস্তি। এখানে একসঙ্গে তিনশ’ ঘর। বস্তির মাঝখান দিয়ে ছোট পানির প্রবাহ বয়ে চলেছে। আর বস্তিজুড়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার। বালতি, কলসিসহ নানা পাত্র দিয়ে রেখেছেন সিরিয়াল। জানা যায়, দিনে দু’বার পানি মেলে।
বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন জেসমিন বেগম। মুখে পান, কোলে ছোট্ট বাচ্চা। পিক ফেলতে ফেলতে বলেন, কিসের করোনা। পেটে ভাত যাওয়া নিয়া কথা। ভাত পাইলেও হয় না। পানিতো লাগবো। আমগো গরিব মাইনষের করোনা হয় না। তার পাশে পানির অপেক্ষায় থাকা আলেয়া বানু হাসির ছলে বলেন, আমগো শরীরে করোনা ঢুকলেও টিকবো না। হেও মইরা যাইবো।
আরেক গৃহকর্মী মমতাজ বলেন, আমি যে বাড়িতে কাজ করি। হেগো ব্যাগতের করোনা হইল। আমি তাও যাইয়া কাম করছি। একটা কাশিও হয় নাই।
পাশেই চায়ের ছোট দোকানে বেশ ভিড়। টিভিতে চলছিল প্রয়াত চিত্রনায়ক জসিম অভিনীত ‘ওস্তাদ সাগরেদ’ সিনেমা। চা-সিগারেট হাতে প্রায় ১০ থেকে ১২ জন দর্শক। ছিলেন প্রায় ৭০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ আজগর আলী। তিনি বলেন, আল্লাহ্‌র রহমতে এই বস্তিতে কোন করোনা রোগী পাওয়া যায় নাই। জ্বর-সর্দি হইলে এমনিতেই দোকান থেকে ওষুধ নিয়া খাইছে।
বস্তির বাইরে বেশ কয়েকটি ফার্মেসির দোকান। এআর ফার্মা ঠিক বস্তির গলির মুখে। দোকানে বসা আলভি আহমেদ বলেন, করোনার সময়ে স্বাভাবিক ছিল ওষুধ বিক্রি। আর শীতের শুরুর দিকে একটু জ্বর-সর্দির ওষুধ বেশি বিক্রি হয়েছে। তবে দেখে বলাতো সম্ভব না। মনে হয়েছে কেউ করোনা আক্রান্ত না।
বস্তিতে ছোট্ট একটি বাঁশ-কাঠ দিয়ে ঘর করে মসজিদ বানানো হয়েছে। মসজিদের ইমাম মো. এরশাদুল ইসলাম বলেন, করোনার বন্ধের সময় কেউ মৃত্যু বরণ করেননি। তবে মাসখানেক আগে একজন বৃদ্ধ মো. খালেক মারা যান। শুনেছি তার করোনার কোন উপসর্গ ছিল না।
খালেকের ঘরে গিয়ে দেখা যায় তালাবদ্ধ। তার ছেলে রড-সিমেন্টের দোকানে কাজ করেন। আর তার স্ত্রী কাজ করেন হোটেলে। তার প্রতিবেশী রাহেলা বেগম ঘরের দরজায় বসে সবজি কাটছিলেন। তিনি বলেন, বুড়ার বয়স হইছিল। ৮০-৮৫ হইবো। মেলা দিন বাড়িত পড়া আছিল। হাসপাতালেও আছিলো মেলা দিন। মাসখানেক বাড়িত থাকার পর মারা যায়। তিনি জানান, তার কোনো করোনার উপসর্গ ছিল না।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031