দুলাল এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন । লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে পরিবার নিয়ে ওঠেন কদমতলী থানার মেরাজনগরে। সেখানকার এক গ্যারেজ থেকে সিএনজি ভাড়া নিয়ে নামেন ঢাকার রাজপথে। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তার স্বপ্ন মিইয়ে যায়। এক বুক স্বপ্নে ঠাঁই নেয় এক বুক ব্যথা। এ ব্যথা নিয়েই তিনি ঢাকা ছাড়েন গতকাল। কেন তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হলো? কি ব্যথা তাকে মুচড়ে দিয়েছে? পঁয়ষট্টি বছর বয়সের দুলাল বলেন, আর পারছি না। সিএনজি চালাতে গিয়ে নিজের ঈমান বিকিয়ে দিতে হচ্ছে।

চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে বেহায়াপনা। নষ্টামি। বলেন, জানুয়ারির মাঝামাঝি ধানমণ্ডি থেকে দুটি মেয়ে উঠেন সিএনজিতে। যাবেন উত্তরায়। মহাখালিতে একজন নেমে যান। অন্যজনকে নিয়ে এগিয়ে চলছি। এয়ারপোর্ট পেরুনোর পর একটি গলিপথে আমাকে থামান। কাগজে লেখা কি ওষুধের নাম লিখে আমার হাতে দিয়ে বলেন, ওই ফার্মেসিতে গিয়ে দেখেন এটি আছে কিনা? আমি যাই।

ফার্মেসিওয়ালা কাগজ দেখে বলেন, নেই। এরপর আমাকে নিয়ে ওষুধের দোকান খুঁজতে থাকেন। প্রায় ১০ থেকে ১২টি ওষুধের দোকান ঘুরে পাওয়া যায় সেই ওষুধ। দাম ১২০০ টাকা করে। এসে বলি। মেয়েটি ২৫০০ টাকা দিয়ে বলেন, দুটি নিয়ে আসুন। আমি সিরাপের দুটি বোতল এনে দেই। এবার গন্তব্যে যেতে থাকি। একটু পরে পেছনে দেখি মেয়েটি মাতলামি করছে। উত্তরার শেষ মাথায় চলে গেছি। কোথাও দাঁড়াতে বলছে না। আমি জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলছে না। একেবারে পুরো মাতাল অবস্থা। আমি বুদ্ধি করে একটি পার্কের সামনে নিয়ে গাড়ি থামাই। দুই তিনজনকে ডেকে এনে পরিস্থিতি দেখাই। এরই মধ্যে তার ব্যাগে থাকা মোবাইল ফোন বাজতে থাকে। তাদের একজন মোবাইল ফোনটি রিসিভ করে ঘটনা জানায়। বলে, গাড়িটি অমুক জায়গায় আছে। আপনি এসে মেয়েটিকে নিয়ে যান। দশ মিনিটের মধ্যেই একটি মোটরসাইকেলে দুটি ছেলে আসে। তারাই ধরাধরি করে মেয়েটিকে গাড়ি থেকে নামায়। এরপর দুই জনের মাঝে বসিয়ে মোটরসাইকেলে করে মেয়েটিকে নিয়ে যায়। ৩০০ টাকা ভাড়ায় চুক্তি করেছিলাম। সেই টাকা পাইনি। তবে ওষুধ কেনার পর ১০০ টাকা আমার কাছে ছিল। সেটিই আমি পেয়েছি। সিএনজি চালক দুলাল বলেন, আরেক দিন একটি ছেলে ও একটি মেয়ে শাহবাগ থেকে উঠে। তারা যাবেন বনানী। গাড়িতে উঠেই তারা দুই পাশের পর্দা ফেলে দেয়। এরপর দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে যা করে আমি বলতে পারবো না। একে অপরকে কোলে নিয়ে আদর করা। চুমু দেয়া। নাহ! আর কিছু বলতে পারছি না। দুলাল বলেন, এ অভিজ্ঞতা শুধু আমার নয়। ঢাকা শহরে যারা সিএনজি অটোরিকশা চালান তাদের প্রত্যেকের। জিজ্ঞেস করে দেখুন, তারা প্রায়ই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। দুলালের কথা-আমার ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। গ্রামে আমার একটি সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। যেটি ভাড়া দেয়া। কিছু জমি আছে। ঠিক করেছি, এমন বেহায়াপনা দেখে আমি নিজেকে আর অপবিত্র করবো না। ঈমান নষ্ট করবো না। গ্রামে গিয়ে নিজের জমিতে ফসল ফলাবো আর আধাবেলা সিএনজি চালাবো। আমার বেশি টাকার দরকার নেই। অল্পতেই চলবে। গতকাল সকালে ঢাকা ছাড়ার সময় তার চোখ বেয়ে পড়ছিল পানি। যাবার সময় বলে গেলেন, স্যার দোয়া করবেন। ঈমান নিয়ে যেন মরতে পারি। করোনাকালে আমার অফিস সময়ে প্রায় দিনই অপেক্ষা করতেন দুলাল। দীর্ঘ প্রায় এক বছরে তার গাড়িতে অসংখ্যবার চড়েছি। সে হিসেবে তার সঙ্গে একটা সখ্য গড়ে উঠে। আসা-যাওয়ার পথে নানা বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা হতো। আর শেষদিন তার সিএনজি চালানোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আমার কাছ থেকে বিদায় নিলো। ছেড়ে গেল ঢাকা।

শামীমুল হক

 

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031