ঢাকা :  কথাও হয়নি মায়ের সঙ্গে। সিয়াম ফিরেছেন। তবে লাশ হয়ে। ‘মা আমি সিলেট পৌঁছে গেছি। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কের সমস্যা। ফোন দিয়েও কোনো লাভ নেই। তোমরা আমাকে পাবে না। চিন্তা করো না। নেটওয়ার্কে ফিরে আমি ফোন দিব।’- এই ছিল মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটের) মেধাবী শিক্ষার্থী মশিউর রহমান সিয়ামের শেষ কথা। সিয়ামের আর নেটওয়ার্কে ফেরা হয়নি।
ওদিকে সিলেট থেকে মায়ের জন্য উপহার কিনে আনতে চেয়েছিলেন বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী সাঈদ নাসিফ। কী সেই উপহার- জানতেন না তার মা নাসিমা আখতার। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর ছেলের সঙ্গে যখন তার শেষ কথা হয়, তখন নাসিফ বলেছিলেন, ‘মা তোমার জন্য সিলেটে একটা জিনিস পছন্দ করেছি। যাওয়ার সময় তোমার জন্য উপহার নিয়ে যাব।’ কিন্তু নাসিফেরও সেই সাধ মিটল না। কেনা হলো না মায়ের জন্য উপহার।
বৃহস্পতিবার বিকালে সিলেটে গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছানাকান্দিতে পিয়াইন নদে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যান মশিউর রহমান সিয়াম (২৩) ও সাঈদ নাসিফ (২৪)। তারা দুজনই বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সিয়ামের বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর শেখপাড়া এলাকায়। তার বাবা মাহবুবুর রহমান আলো একজন পান দোকানদার। মা রুমা বেগম গৃহিণী। এই দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে সিয়ামই বড়।
নাসিফের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার বড় জামালপুরে। বাবা নুরুল ইসলাম রাজশাহী কলেজের শিক্ষক। মা নাসিমা আখতারও রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক। তারা রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তবে নাসিফের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে গ্রামের বাড়িতে।
সিয়াম অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডেও মেধাতালিকায় তার অবস্থান ছিল ১৩। ২০১৫ সালের এইচএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে তিনি প্রথম স্থান দখল করেন। আর সারাদেশের মেধাতালিকায় স্থান পঞ্চম। নাফিসও খুব মেধাবি ছিলেন। তারা দুজনই এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। দুজন ভালো বন্ধুও ছিলেন। তাই ভর্তিও হয়েছিলেন একসাথে।
রাজশাহীর এমন দুজন কৃতি শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে শহরজুড়ে শোকের মাতম পড়েছে। আলোচনা চলছে দোকানে-দোকানে, পথে-ঘাঁটে।
সিয়ামের মামা বেলাল উদ্দিন সাজু জানান, বুয়েটে পরীক্ষা শেষে সিয়াম সিলেট বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে। সিয়ামের কাছে টাকা ছিলো না। সে জন্য বিকাশ করে পাঁচ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিলো। সেই টাকা নিয়েই সিয়াম সিলেট যায়। সে সাঁতার জানতো না। এ জন্য ফোনে তার মা বারবার সর্তক করে দিয়েছিলেন।
চোখের পানি মুছে বেলাল উদ্দিন সাজু বলেন, পরিবারের সব স্বপ্নই ছিলো ওই সিয়ামকে ঘিরে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। সিয়ামের বাবা পান দোকানদার। সিয়ামের ইচ্ছে ছিলো স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাবে। সে জন্য তার বাবা খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাতে শুরু করেছিলেন।
সিয়ামের চাচাতো ভাই সৌরভ-বুর-রহমান রিমন বলেন, ‘মাঝে মাঝেই এমন দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কলেজ-ভার্সিটির মেধাবী শিক্ষার্থীদের এভাবে হারিয়ে যেতে দেখা যায়। তাই আমাদের দাবি, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে ভ্রমণ সচেতনতার একটি অধ্যায় সংযুক্ত করা হোক।’
শুক্রবার দুপুরে সিয়ামের লাশ বাড়িতে এসে পৌঁছালে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে বাদ আসর হেতেম খাঁ বড় মসজিদে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাকে হেতেম খাঁ গোরস্থানে দাফন করা হয়।
বৃহস্পতিবার বুয়েট থেকে ১৪ জন শিক্ষার্থীর একটি দল সিলেটের বিছানাকান্দি বেড়াতে যান। সিয়াম ও নাসিফ ওই দলে ছিলেন। বিকেল ৪টার দিকে তারা পিয়াইন নদে গোসল করতে নামেন। এ সময় পাহাড়ি ঢলের ¯্রােতে ভেসে গিয়ে সিয়াম ও নাসিফ নিখোঁজ হন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ তাদের মরদেহ উদ্ধার করে।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031