জনপদে টানা ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢলের পানিতে টইটম্বুর সিলেট অঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদী। দুই কূল ছাপিয়ে প্রধান কয়েকটি নদীর পানি উপচে ঢুকে পড়েছে জনপদে। এর ফলে সিলেট জেলাজুড়ে আগাম দেখা দেওয়া বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সিলেটবাসী। বন্যার পানিতে বিদ্যুতের সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়া ও বাসা-বাড়িতে বৈদ্যুতিক মিটারে পানি ওঠায় সিলেটের অন্তত ৫০ হাজার পরিবার বিদুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সিলেট নগরীর বাসিন্দারাও।

বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল সুনামগঞ্জ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া জেলার ২২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৪৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে তিন হাজার বিঘা জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

সিলেট : সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা এখন ফুঁসছে। অন্তত চারটি পয়েন্টে এ দুই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বৃষ্টির পরিমাণ খানিকটা কমে আসায় আজ বৃহস্পতিবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতির আশা

করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেট সদর উপজেলার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে আছে। এসব এলাকাতে নতুন করে বিভিন্ন জনপদ প্লাবিত হয়েছে।

বুধবার সকাল পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বেড়েছে দুর্ভোগ। বিপর্যস্ত হয়ে আছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিভিন্ন উপজেলায় প্লাবিত এলাকায় বাঁধ ও পাকা রাস্তাসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া লোকজন বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য ও শৌচাগার সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় বাঁধ ও পাকা রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় মানুষজনকে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

পাউবো সিলেটের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এ. কে. এম. নিলয় পাশা জানান, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। নতুন করে বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভাঙনের খবর সংগ্রহ করছেন তারা।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। সিলেটে আগামী ২০-২১ জুন পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। যে কারণে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এ ছাড়াও চাল ও শুকনো খাবার বিভিন্ন উপজেলার বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।

এদিকে বন্যাকবলিত সিলেট জেলায় বন্যার্তদের জন্য ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রায় দেড়শ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। সঙ্গে শুকনো খাবারও বিতরণ করা হচ্ছে। বুধবার বেলা পৌনে ১২টায় এ তথ্য জানান সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম।

এদিকে বন্যার পানিতে বিদ্যুতের সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়ায় ও বাসা-বাড়িতে বৈদ্যুতিক মিটারে পানি ওঠায় সিলেট নগরীতে অন্তত ৫০ হাজার পরিবার বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদির জানান, দক্ষিণ সুরমা, উপশহরসহ কয়েকটি এলাকার বিদ্যুতের সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে এসব এলাকায় মঙ্গলবার থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। জলাবদ্ধতা না কমা পর্যন্ত এসব এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মঙ্গলবার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত নগরীর ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দা দৈনন্দিন ব্যবহার্য ও খাবার পানির সংকটে রয়েছেন।

সুনামগঞ্জ : গতকাল বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি কমলে বিকাল থেকে পানি স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম। গতকাল বিকালে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ৭.৯৭ মিটারে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।

পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া জেলার ২২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৪৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা।

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ১৫ টন চাল, আড়াই লাখ টাকা ও দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় সাত হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। আর বৃষ্টিপাত না হলে আশা করছি বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

জকিগঞ্জ (সিলেট) : কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি বেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করায় জকিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বাড়তে থাকায় মঙ্গলবার রাত থেকে তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ডাইক উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। ইউপি চেয়ারম্যানরা ও এলাকাবাসী ডাইকের ওপর বালুভর্তি বস্তা ফেলেও পানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এর ফলে নদীর তীরবর্তী গ্রামের লোকজনের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ফলে তারা বাড়িঘর ছেড়ে গৃহপালিত পশু নিয়ে অন্যত্র অবস্থান নিয়েছেন। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষজন।

বিশ্বনাথ (সিলেট) : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে আকস্মিক বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে সিলেটের বিশ^নাথ উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন। গত তিন দিনে প্লাবিত হয়েছে ওই তিনটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল। প্রথমে সুরমা নদী উপচে লামাকাজি ও খাজাঞ্চী ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করে। পরে পানি প্রবেশ করে অলংকারী ইউনিয়নেও। ফলে প্লাবিত হয়েছে অনেক বাড়িঘর, হাটবাজার, গুচ্ছগ্রাম, ধর্মীয় উপাসনালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, ধানি জমি, আউশ ধানের বীজতলা, সবজি ক্ষেত, পোল্ট্রি ও মৎস্য খামার।

গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : ভারত থেকে বয়ে আসা ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার বিঘা জমির ধান।

রাধানগর ইউপির উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফুয়াদ আলী জানান, রাধানগর ইউপির তিনটি মৌজায় প্রায় ১৬৭০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষাবাদ হয়েছে। এখানে ৮-১০ হাজার বিঘা জমির মধ্যে আড়াই-তিন হাজার বিঘা জমির ধান এখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

Share Now
November 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930