তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর ভাষার জন্য বাঙালির রক্তদানের স্মৃতি জড়ানো একুশের গানের রচয়িতা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী আর নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম জানিয়েছেন। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ও সংগঠন। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তাকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হবে।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম বলেন, গত কিছুদিন ধরে গাফফার চৌধুরী হাসপাতালে ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে উনার মৃত্যু হয়েছে বলে উনার মেয়ে আমাকে জানিয়েছেন। আমরা গভীরভাবে শোকাহত।
বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁক বদলের সাক্ষী গাফফার চৌধুরী ছিলেন একাত্তরের মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলার নির্বাহী সম্পাদক। ১৯৭৪ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করলেও মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে তার কলম সোচ্চার ছিল বরাবর। প্রবাসে থেকেও ঢাকার পত্রিকাগুলোতে তিনি যেমন রাজনৈতিক ধারাভাষ্য আর সমকালীন বিষয় নিয়ে একের পর এক নিবন্ধ লিখে গেছেন, তেমনি লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধ।
বিডিনিউজের খবর থেকে জানা যায়, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত গাফ্‌ফার চৌধুরীকে মাস দুই আগে লন্ডনের নর্থ উইক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই এপ্রিলে মারা যান তার মেয়ে বিনীতা চৌধুরী। গাফফার চৌধুরীর চার মেয়ে এবং এক ছেলের মধ্যে বিনীতা ছিলেন তৃতীয়। বাবার সাথেই তিনি লন্ডনের এজওয়ারের বাসায় থাকতেন, তার দেখাশোনা করতেন। তার বয়স হয়েছিল ৫০ বছর।
প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নে লন্ডনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, গাফফার চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তাকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হবে। তিনি বলেন, শুক্রবার লন্ডনের ব্রিক লেইন মসজিদে গাফফার চৌধুরীর প্রথম জানাজার নামাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে হাই কমিশন। ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের ‘বাতিঘর’ গাফফার চৌধুরীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ লন্ডনের শহীদ আলতাফ আলী পার্কে রাখার পরিকল্পনার কথাও জানান হাই কমিশনার।
১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার উলানিয়া গ্রামে আবদুল গাফফার চৌধুরীর জন্ম। হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মোসাম্মত্‌ জহুরা খাতুনের তিন ছেলে পাঁচ মেয়ের মধ্যে গাফফার চৌধুরী ছিলেন তৃতীয়। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে হাইস্কুলে ভর্তি হন গাফফার চৌধুরী। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান।
বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৬ সালে গ্রাম ছেড়ে বরিশাল শহরে চলে এসেছিলেন গাফফার চৌধুরীরা। তখন থেকেই লেখালেখির শুরু। স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তার প্রথম গল্প ছাপা হয় সওগাত পত্রিকায়।
পরে দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাত, মাসিক নকীব পত্রিকায় তিনি কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে। দুবছর পর মানিক মিয়া তার নতুন রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’ এর দায়িত্ব দেন আবদুল গাফফার চৌধুরীকে। সামরিক শাসন জারি হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক জেহাদ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় বিভিন্ন পদে কাজ করেন গাফফার চৌধুরী। ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসা করার চেষ্টায় অনুপম মুদ্রণ নামে একটি ছাপাখানা খোলেন।
দুবছর পর আবার সাংবাদিকতায় ফিরে ১৯৬৬ সালে বের করেন ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র ‘দৈনিক আওয়াজ’। পরে আবার দৈনিক আজাদ হয়ে ফেরেন ইত্তেফাকে। ১৯৬৯ সালে মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক পূর্বদেশে যোগ দেন গাফফার চৌধুরী।
তরুণ বয়সে বহু কবিতা লেখা গাফফার চৌধুরীর প্রথম বইটি ছিল শিশুদের জন্য। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ের নাম ছিল ‘ডানপিটে শওকত’। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কৃষ্ণপক্ষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’।
নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ, সম্রাটের ছবি, সুন্দর হে সুন্দর, বাংলাদেশ কথা কয় তার লেখা বইগুলোর অন্যতম। তার লেখা নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’। নিজের লেখা রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ অবলম্বনে ২০০৭ সালে একটি টেলিভিশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন গাফফার চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন ‘দুর্গম পথের যাত্রী’।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মানিক মিয়া পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গাফফার চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
রাষ্ট্রপতির শোক : শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারাল।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিকে জাতি হারাল, যিনি তার লেখা ও গবেষণায় বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন। তিনি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
শিক্ষা উপমন্ত্রী : ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র রচয়িতা। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন সাহসী সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারালাম।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ : চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন শোক বার্তায় বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার ধারক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আমৃত্যু যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হন। সেখান থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ও একাত্তরের পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে কলম যুদ্ধ চালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রাণিত আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ছিলেন বাংলা ও বাঙালির শুদ্ধতম বাতিঘর। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্ব বিবেক ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
চউক চেয়ারম্যান : চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম. জহিরুল আলম দোভাষ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে মরহুমের কর্মময় জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031