আপন দুই খালাতো বোনের মুখে এসিড নিক্ষেপের মামলায় দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৮০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত । তারা হলেন ফারজানা লতিফ সাকি (৩৫) ও তার ছোট ভাই ইফতেখার লতিফ সাদি (৩৩)। গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ নারগিস আক্তার এ রায় ঘোষণা করেন। এ সময় দুই আসামি কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তসলিম উদ্দিন আজাদীকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সন্দেহাতীতভাবে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫(ক) ধারায় দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এছাড়া এ আইনের ৫(খ) ধারায় তাদের দুজনকে আরো ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ দুটি ধারার সাজা একই সঙ্গে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারক। একযুগ আগের এ মামলার পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় আদালত ২৫ জন সাক্ষীর মধ্য থেকে ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে বলেও জানান তিনি। আসামি পক্ষের আইনজীবী শম্ভু প্রসাদ বিশ্বাস বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। ২২–২৩ বছরের একজন মেয়ে নিজের খালাতো বোনদের এসিড মারবে আবার পরে নিজের মুখে এসিড মাখবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যারা সাক্ষী দিয়েছেন কারা কেউ প্রত্যক্ষদর্শী নন। আশা করি উচ্চ আদালতে কাঙ্ক্ষিত বিচার পাব।

এদিকে রায় পরবর্তী সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে মামলার বাদী ও ভিকটিমদের বাবা আনোয়ারুল মুবিন বলেন, আমার দুই মেয়ে মুমতাহা কারিনা ও সালসাবিল তাসনিম এখনো সেই ভয়াবহ ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘটনার সময় কারিনার বয়স ছিল ১৯ বছর, তাসনিমের ছিল ১৬ বছর। বড় মেয়ে কারিনা সাকির ছোট। তার বিয়ে কেন আগে ঠিক হয়েছে, তা নিয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার দুই মেয়েকে এসিড মেরে ঝলসে দেয় সাকি। ওর কথায় ওর ভাই সাদি ওই এসিড এনে দিয়েছিল। আদালতও বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। এ সময় আনোয়ারুল মুবিনের পাশে ছিলেন তার স্ত্রী আনার কলি।

সেদিন যা ঘটেছিল : সাকিদের বাসা নগরীর বাদুরতলায়। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি চকবাজারের জয়নগরে খালার বাসায় বেড়াতে যান। ১০ অক্টোবর তার খালাতো বোন কারিনার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিল। সেজন্য আত্মীয়দের দাওয়াত দিতে ১ অক্টোবর সকালে কারিনার বাবা আনোয়ারুল মুবিন ও মা আনার কলি চকরিয়ায় গ্রামের বাড়িতে যান। পরদিন ২ অক্টোবর আপন দুই খালাতো বোনকে এসিড নিক্ষেপ করে সাকি ও সাদি। কারিনা ও তাসনিমের বাবা আনোয়ারুল মুবিন ওই ঘটনায় মামলা করেন। সেখানে বলা হয়, ২ অক্টোবর ভোরে ঘুমন্ত দুই খালাতো বোন কারিনা ও তাসনিমের মুখে এসিড ছোড়ার পর বাথরুমে গিয়ে সাকি নিজের মুখেও এসিড মাখেন, যাতে অন্য কেউ হামলা করেছে বলে সাজানো যায়। আগের রাতে কারিনা ও তাসনিমের সঙ্গে একই ঘরে ঘুমিয়েছিলেন তিনি।

আদালতসূত্র জানায়, মামলা হওয়ার পর তখনকার কলেজ ছাত্রী সাকি ও তার ভাই সাদিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিছুদিন পর আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। পুলিশের এ চার্জশিট গ্রহণ করে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ হয়।

এখন কেমন আছেন কারিনা–তাসনিম : এক যুগ আগে ঘটা সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন দুই বোন মুমতাহা কারিনা ও সালসাবিল তাসনিম। তাদের চিকিৎসায় শহরের সব স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলায় পরিবারটি এখন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। তবে এসিড ছুড়েও বিয়ে আটকানো যায়নি। ঘটনার ছয় মাস পর ঠিক করা পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে হয় কারিনার। পরে ছোট মেয়ে তাসনিমেরও বিয়ে হয়। মা আনার কলি বিডিনিউজকে জানান, ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর বড় মেয়ে কারিনার বিয়ের দিন ঠিক হয়। ছেলে বিসিএস ক্যাডার, তখন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করতেন। ঘটনার পরবর্তী সময়ের বর্ণনা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন আনার কলি। তিনি বলেন, আমার মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। আমার যা ছিল সবই তাদের চিকিৎসার জন্য খরচ করে ফেলেছি।

তিনি জানান, ২০১০ ও ২০১২ সালে দুই মেয়েকে নিয়ে দু’বার ব্যাংককে যান চিকিৎসা করাতে। খরচ যোগাতে শহরের চট্টেশ্বরী রোড ও টেঙটাইল এলাকায় কিছু জমি ছিল, সেসব বিক্রি করা হয়েছে। আগামী মাসে গ্রামে চলে যাব। শুরুতে অনেক দামি দামি ইনজেকশন দেওয়া হয়। পরে সেখানকার ডাক্তার আবার নিতে বলেছিলেন প্লাস্টিক সার্জারির জন্য। তা আর নেওয়া হয়নি। কারিনা এখন দুই সন্তানের মা, ছোট মেয়ে তাসনিম একটা চাকরি করেন।তিনি জানান, রায়ের খবর শুনে দুই মেয়ে মা–বাবাকে ফোন করে কথা বলেছেন। তারা রায়ে খুশি।

Share Now
December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031