ভূমি জালিয়াত চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বান্দরবানে । জেলা প্রশাসন এবং বোমাং সার্কেল চিফের কর্মচারীদের যোগসাজশে বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে জায়গা বিক্রি করা হচ্ছে। ভূমি জালিয়াত চক্রটি জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুম থেকে বাবা–মায়ের নামের সাথে মিল থাকা ব্যক্তিদের ভুয়া জবানবন্দি বের করে ভূমি রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
জানা গেছে, ভূমি জালিয়াত চক্রের মূল হোতা হচ্ছেন জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ক্যান্টিনের মালিক বাবুল দাস, জেলা প্রশাসনের নাইটগার্ড মো. ইউনুচ, বোমাং সার্কেল চিফ কার্যালয়ের হেডক্লার্ক অংজাই এবং জেলা প্রশাসনের সাবেক নাজির মো. আইয়ুব। এদের সাথে জেলা প্রশাসনের রেকর্ডরুম, ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মচারীও জড়িত রয়েছে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি মোতাবেক পার্বত্যাঞ্চলে জমি নেই এমন কেউ তিন পার্বত্য জেলায় কোনো জমি কিনতে পারবেন না। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অর্থের বিনিময়ে জায়গার ভুয়া জমাবন্দি এবং বোমাং সার্কেল চিফ (রাজার সনদ) স্থায়ী বাসিন্দার সনদ নিয়ে অন্যস্থানের জমির ভুয়া কাগজ চৌহদ্দি মিলিয়ে বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সরকারি খাস জমি বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বহিরাগতদের কাছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূয়ালকের কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ অভিযোগ করে বলেন, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখে জমিগুলো চট্টগ্রাম বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল। গর্জন, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান বড়বড় মাদার ট্রি ছিল। সবগুলো গাছ রাতের আঁধারে কেটে ফেলা হয়েছে বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে। জায়গাটি বৃক্ষশূন্য করে সেখানে জমির মালিকানা দাবি করে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন ভূমি জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। শুনেছি রতন দে শাওন, আনিসুর রহমান সুজন এবং আরও কয়েকজনের নামে সরকারি জমির বেচাকেনা রেজিস্ট্রেশনও করা হয়েছে। যার মধ্যে রতন দে শাওনের পিতা মাতার নামে কোনো মৌজায় জমি নেই বান্দরবান জেলায়। রতনের বাবার নাম স্বপন দে, দাদার নাম নগেন্দ্র দে। যা জমাবন্দির ব্যক্তির বাবার নামের সাথে মিল নেই। বিষয়টি ধাপাচাপা দিতে দাদার নাম মিলাতে বাবার ভোটার আইডি সংশোধনের আবেদনও করেছেন নির্বাচন অফিসে। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ভুয়া কাগজপত্র বের করে সরকারি জায়গা বিক্রি করা হয়েছে। বনবিভাগের সরকারি ৫ একর জায়গা ইতিমধ্যে বিক্রির নামে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
সূয়ালকের বাসিন্দা জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি কাজী নাছিরুল আলম অভিযোগ করে বলেন, সূয়ালক বাজার থেকে হলুদিয়া বাজার পর্যন্ত রাস্তার দুপাশের বনাঞ্চলের জায়গাটি চট্টগ্রাম বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি। ছোট্ট বেলা থেকেই দেখেছি বনবিভাগের লোকজন জায়গাটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং গাছের চারা রোপণ ও পরিচর্যা করতেন। কিন্তু ভূমি জালিয়াত চক্র জেলা প্রশাসনের সাবেক এক কর্মচারীর নামে ভুয়া কাগজপত্রের চৌহদ্দি মিলিয়ে বসিয়ে রাতের আঁধারে সবগুলো গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছে। গাছের গোড়ার চিহ্নগুলো এখনো দৃশ্যমান রয়েছে। শুনেছি বিভিন্ন জনের নামে বনবিভাগের সরকারি জমিগুলো বিক্রিও করে দিচ্ছেন সাইনবোর্ড লাগিয়ে। সরকারি জমি ও বনাঞ্চল রক্ষায় সূয়ালকের বাসিন্দারা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিবেন।
বনবিভাগের সরকারি জমির মালিক দাবিদার অভিযুক্ত জেলা প্রশাসনের সাবেক নাজির মো. আইয়ুব বলেন, আমার নামীয় ৫ একর জায়গার কাগজ কিনে নেন ক্যান্টিন বাবুল দাস গং। তারাই মূলত জায়গা বিক্রি করছেন।
জালিয়াত চক্রের মূলহোতা জেলা প্রশাসনের ক্যান্টিনের মালিক বাবুল দাস ও জেলা প্রশাসনের নাইটগার্ড মো. ইউনুচ বলেন, জায়গাটি জমির রেকর্ডিয় মালিক আইয়ুব সাহেবের কাছ থেকে কিনেছি। উনার নামে জমির বৈধ সব কাগজপত্র রয়েছে। বনবিভাগের জমি জায়গাটির পাশ্ববর্তী। তবে ভুয়া কাগজপত্র বসিয়ে বহিরাগতদের কাছে সরকারি জমি বিক্রির অভিযোগ তারা অস্বীকার করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে বান্দরবান বোমাং সার্কেল চিফ কার্যালয়ের হেডক্লার্ক অংজাই বলেন, কোনো ধরণের ভূমি জালিয়াতি চক্র এবং রাজার জাল সনদ প্রদানের সাথে আমি জড়িত নই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ভুলক্রমে দেয়া রাজার সনদ তাৎক্ষণিক বাতিল করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের এনডিসি ও রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা আব্দুল আল মামুন বলেন, রতন দে শাওন নামের একজনের নামে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রেশনের অভিযোগ পেয়েছি। ভূমি জালিয়াতির প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাতিল করা হবে ভূমির রেজিস্ট্রেশনও। আটকে দেয়া হবে উপজেলা পর্যায়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশনের সব কার্যক্রমও। জেলা প্রশাসনের কোনো কর্মচারী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণের রেঞ্জ অফিসার মো. মোরশেদ বলেন, হলুদিয়ার আশপাশের এলাকায় ১৯৯৫ সালে গড়ে তোলা ৫০ একরের বেশি ন্যাচারাল ফরেস্ট এবং ১৫/২০ একর সামাজিক বনায়ন রয়েছে।
বনবিভাগের চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগীয় কর্মকর্তা আব্দুল আল মামুন বলেন, বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি জবর দখলের কোনো সুযোগ নেই। আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভূমি জালিয়াত চক্রের সাথে বনবিভাগের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।